মধ্যপ্রাচ্যের পাঁচ দেশে গত সাত বছরে ২৭৩ নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। নারী শ্রমিকের লাশ আসা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৌদি আরব, জর্দান, ওমান, লেবানন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দূতাবাসে মৃত নারী শ্রমিকদের তালিকা চেয়ে পাঠায়। ওই তালিকা থেকেই এই তথ্য জানা গেছে।
এমন একাধিক নারী শ্রমিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। স্বজনরা এমন মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মেনে নিতে পারছে না। পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করে তারা এসব মৃত্যুকে হত্যা বলে দাবি করেছে। চেয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত।
আত্মহত্যার এই বিপুল সংখ্যার কথা জানার পর গত ২০ মার্চ বৈঠক করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকের ওপর নির্যাতন ও মৃত্যু কমাতে ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে।
দূতাবাসগুলো ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়ে। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ে শুধু সৌদি আরবেই ১৮৩ জন প্রবাসী নারী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে রিয়াদে ১৬৪ জন, আর জেদ্দায় ১৯ জন।
এর বাইরে জর্দানে ৪৩ জন, লেবাননে ২৫ জন, ওমানে ১৫ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে পাঁচজন এবং আবুধাবিতে দুজন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
এই সাত বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ ৩৮ হাজার ৯০৯ জন নারী শ্রমিক এই দেশগুলোতে কাজের জন্য গেছেন।
তথ্য মতে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে ৫০ জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। এরপর আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়তে থাকে। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ২২৩ জন বাংলাদেশি নারী শ্রমিক।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯-এই চার বছরে গড়ে ১২ জন নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ থেকে ২০২২-এই তিন বছরে গড়ে ৭৪ জন নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। দেখা যাচ্ছে, করোনাকালীন সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়েছে।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘আমরা বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। পুরো বিষয়টির সমাধানে একটু সময় প্রয়োজন। নিশ্চয়ই আমরা এটি বন্ধ করতে সক্ষম হব।’
আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টির সমাধান না হলে এটি বন্ধ করা কঠিন হবে বলে মনে করেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “এখন আমাদের একটাই দায়িত্ব-এই আলাপটাকে আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিষ্ঠিত করা। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়াসহ যারা মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠায়, সবার একত্র হয়ে বলতে হবে, ‘তোমরা এটা বন্ধ করো, নইলে আমরা কর্মী পাঠাব না।”
পরিবারের সংশয় : হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের মেয়ে শেফালি আক্তার। ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান সৌদি আরব। শুরুর দিকে ভালোই ছিলেন শেফালি। ধীরে ধীরে তাঁর ওপর শুরু হয় গৃহকর্তার নানা ধরনের নির্যাতন। এরই মধ্যে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি শেফালি শেষবার দেশে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। শেফালি মা-বাবাকে বলেছিলেন, তিনি ভালো আছেন। মা-বাবাও যেন ভালো থাকেন। টাকা পাঠিয়েছেন। মা-বাবা পেয়েছেন তো! রোজার মাসে তিনি দেশে ফিরে আসবেন।
এর পর থেকে শেফালির সঙ্গে মা-বাবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যোগাযোগের বহু চেষ্টা করেছে পরিবার। ২০ থেকে ২৫ দিন পর সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে শেফালির বাবাকে জানানো হয়, তাঁর মেয়ে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
শেফালির বাবা আনোয়ার আলী বলেন, ‘শেফালি আত্মহত্যা করেছে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমার মেয়ে আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে না। ওর মৃত্যু সনদে আত্মহত্যার কথা লেখা থাকলেও আমি মনে করি, ওকে ওরা মেরে ফেলেছে।’
মানিকগঞ্জের দক্ষিণ সাখারিয়ার সাবানা বেগম। টানাটানির সংসারে ছেলেমেয়েদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে ২০২০ সালে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ওমানে। সেখানে কাজের শুরু থেকেই গৃহকর্তা কর্তৃক নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে শুরু করেন তিনি। মেয়ে ইয়াসমিন আক্তারকে ফোনে সেসব কষ্টের কথা জানিয়েছেন তিনি।
ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার মা ওদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে থানায় যান। থানা থেকে মালিককে ডেকে পাঠানো হয়। মালিক থানায় হাজির হয়ে বলেন, তিনি আর এ রকম করবেন না। পরে আমার মাকে আবার নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর নতুন করে শুরু হয় নির্যাতন। সে নির্যাতনেই আমার মা মারা গেছেন। এখন বলা হচ্ছে, আত্মহত্যা করেছেন। যদি তিনি আত্মহত্যাও করে থাকেন, তবে প্রশ্ন হলো, কেন তাঁকে আত্মহত্যা করতে হলো? এর জবাব তো কারো কাছে পাইনি।’
১০ সুপারিশ : নারী শ্রমিক বিষয়ে পাঁচ দেশের দূতাবাস থেকে তথ্য পাওয়ার পর গত ২০ মার্চ এই নিয়ে বৈঠক করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকের ওপর নির্যাতন ও মৃত্যু কমাতে ১০টি সুপারিশ করা হয়।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিদেশে নারী কর্মীর মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন করা। এর জন্য বিদেশে শ্রম কল্যাণ উইংকে আরো তত্পর হতে হবে।
কর্মস্থলে ন্যায্য বেতন-ভাতা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ, মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ মানসিকভাবে ভেঙে পড়া নারী কর্মীদের সমস্যা মোকাবেলা ও সহযোগিতার জন্য দূতাবাসে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা। বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত নারী কর্মীর অভিযোগের পর কল্যাণ বোর্ড থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর বিএমইটি ছাড়পত্র দেওয়া। নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্সিকে অধিকতর যাচাই-বাছাইয়ের পর কর্মী নির্বাচন করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো নারী কর্মীকে বিদেশে পাঠালে রিক্রুটিং এজেন্সিকে শাস্তির আওতায় আনা।
বিদেশে যাওয়ার আগে রিক্রুটিং এজেন্সি, নিয়োগদাতা, কর্মী ও কর্মীর পরিবারের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বরসহ একটি তালিকা সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে পাঠানো। নারী কর্মীর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকে আরো বেশি তদারকি করা।
নারী কর্মী যে দেশে যাবেন, সে দেশের শ্রম উইংকে তিন মাস বা ছয় মাস পর পর গৃহকর্মীর সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার ব্যবস্থা করা।