সন্দেহ নেই, ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার সবচেয়ে নন্দিত পুরুষ শামসুর রাহমান। বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন দত্তরা রবীন্দ্রনাথকে ভেঙেচুরে বাংলা কবিতার যে নতুন সড়ক নির্মাণ করেছিলেন, সন্দেহাতীতভাবে সে পথেই হেঁটেছেন শামসুর রাহমান। যে পথ মাড়াতে কিছুদিন ইতস্তত করছিলেন জীবনানন্দ দাশ, যে পথে পা বাড়াননি জসীমউদদীনের মতো বড় কবি এবং কিছুটা শঙ্কিত ছিলেন আহসান হাবীবও। এই অচেনা সড়কের দুপাশে একমাত্র শামসুর রাহমানই বিনা দ্বিধায় রোপণ করেছেন সবুজ গাছ-লতা। সেই সব গাছে এখন অসংখ্য পাখির কূজন। পাখির কলকাকলিতে আমাদের ঘুম ভাঙে প্রতিদিন ভোরে। আধুনিক বাংলা কবিতার ব্যস্ততম মহাসড়কের দুপাশে আজ যে নয়নাভিরাম সবুজ বনানী গড়ে উঠেছে এটা শামসুর রাহমানেরই কৃতিত্ব। তাঁরই সৃষ্টি। আমাদের ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে শামসুর রাহমানের কোনো কবিতা ছিল না। জীবিত কবিদের মধ্যে কেবল, যত দূর মনে পড়ে, জসীমউদদীনের কবিতা পড়েছিলাম। হাইস্কুলের শুরু থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সব ক্লাসেই ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতাটি আমরা পড়েছি। স্পষ্ট মনে আছে আমি কোনো ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকেই অন্তমিল বর্জিত কোনো কবিতা পড়িনি। অন্তমিল ছাড়াও যে কবিতা হয় এটা বুঝতে বোধ করি আমাদের শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিদেরও সময় লেগেছিল প্রায় অর্ধ-শতাব্দী। শামসুর রাহমানের মতো বড় কবিকেও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর এই অন্তর্ভুক্তির লোভে তিনি কখনোই পেছন ফিরে তাকাননি। অনুসরণ করেননি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা জসীমউদদীনের পদাঙ্ক। আধুনিক কবিতার যে বিশুদ্ধ আঙ্গিক তিনি রপ্ত করেছিলেন, তা থেকে বিচ্যুত হননি কখনোই। আমৃত্যু তিনি সে পথেই হেঁটেছেন। এরশাদের শাসনামলেই সম্ভবত সর্বপ্রথম, আশির দশকের গোড়ার দিকে, স্কুল কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তকে আধুনিক কবিতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তখনই সারা দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকের সঙ্গে ব্যাপক পরিচয় ঘটে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ আলী আহসান ও ফজল শাহাবুদ্দীনের কবিতার। যখন স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আবৃত্তি হতে শুরু করে, ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা’ মূলত তখনই এদেশের শিল্পরসিক মানুষ টের পায় আধুনিক কবিতার শক্তি। গণমানুষের সঙ্গে আধুনিক বাংলা কবিতার যেটুকু আত্মীয়তা, যেটুকু যোগাযোগ, তাও শামসুর রাহমানেরই অবদান। তাঁর সমস্ত কবিতার মূল সুরটিই হলো দেশপ্রেম। শামসুর রাহমান কখনোই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। এমন একটি সামাজিক ইস্যু নেই যেটি তাঁকে স্পর্শ করেনি, যা নিয়ে তিনি কবিতা লেখেননি। ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ যেমন আমাদের জাতীয় জীবনের অনেক বড় ইস্যুর ওপর লেখা তেমনি তাঁর অসংখ্য কবিতা আছে যেগুলো ছোট ছোট সামাজিক ও পরিবেশ আন্দোলনের ওপর লেখা।
আশির দশকের মাঝামাঝি এক সময়। ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলার মাস। গুলশান থেকে বাদুড়ঝোলা হয়ে ৬ নম্বর বাস ধরে আসি ফার্মগেট। সেখান থেকে আরেক বাসে শাহবাগ। তারপর হাঁটা। সে-কি উন্মাদনা। মেলায় যাব। বই কিনব। কার বই কিনব? কার আবার, শামসুর রাহমানের। বইয়ের নাম ‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’। এই প্রথম আমি শামসুর রাহমানের বই কিনি। প্রতিটি কবিতা বারবার পড়ি, বহুবার পড়ি। পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলি। তখন থেকেই শামসুর রাহমানের কবিতার সঙ্গে আমার সখ্য। কিন্তু তাঁকে জানতে হলে পেছনের কবিতাগুলোও যে পড়তে হবে। পড়তে শুরু করি।
পড়ি আর শিহরিত হই। নজরুলের পরে আর কে লিখেছে এমন শক্ত দেশের পঙ্ক্তি? একবার কবি, ছড়াকার ফয়েজ আহমদ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘শামসুর রাহমানকে বলেছিলাম, আসাদের শার্টের মতো কবিতা লিখতে। এর পরে যা লিখেছে তা আর স্পর্শ করে না।’ হয়তো ফয়েজ ভাই ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটিতে বড় বেশি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলেই ওটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
আসাদের রক্তাক্ত শার্ট যেমন হয়ে উঠেছিল তখন আন্দোলনের অবধারিত মেনিফেস্টো, ‘আমাদের প্রাণের পতাকা’ ঠিক তেমনি আমাদের চেতনায় আসাদের শার্ট গেঁথে দিয়েছেন কবি শামসুর রাহমান এই কবিতাটি রচনা করে। আসাদের শার্ট এখন বাঙালি জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইমোশনাল এবং ইন্টেলেকচুয়াল রিসোর্স।
১৯৯৯ সালে হঠাৎ এক মৌন সন্ধ্যায় হাজির হই কবির শ্যামলীর বাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন বগুড়ার কবি ফিরোজ আহমদ। এমন সুপুরুষ আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। কী অমায়িক ব্যবহার। নানান অনুষ্ঠানাদিতে তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, কিন্তু এমন ঘরোয়া পরিবেশে কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আর কখনোই আমার আলাপ হয়নি। আমি নুয়ে পড়ে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করি। এই কাজটি আমি সাধারণত করি না। কিন্তু এই মানুষটির অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কাছে আমার মাথা আপনা থেকেই নত হয়ে এল। কবিতা নিয়ে কিছু কথা হলো। মূলত তরুণদের কবিতা নিয়ে তার কী ভাবনা এই বিষয়েই বেশি কথাবার্তা হলো। তিনি তরুণদের কবিতা সম্পর্কে বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করলেও তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না। সাধারণত শামসুর রাহমান কখনোই কোনো বিষয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হতেন না। কিংবা তার উচ্ছ্বাস বোঝা যেত না। এর কয়েক দিন আগেই রামপুরার এক ছেলে (কোনো একটি মৌলবাদী দলের সদস্য) তাঁকে হত্যা করতে তার বাসায় যায়। ভেবেছিলাম তিনি এতে বিচলিত এবং কারও সঙ্গে কথা বলতে বিব্রত হবেন হয়তো। কিন্তু তাঁর আচরণে বিব্রতবোধের লেশমাত্রও ছিল না। তিনি খুব সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। চা এল, বিস্কুট এল। আমরা একসঙ্গে চা খেলাম। আমি তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম আমার সম্পাদিত পত্রিকা ‘কাজীর কাগজ’-এর প্রথম সংখ্যাটির মোড়ক উন্মোচন করার জন্য। তিনি সানন্দে রাজি হলেন।
১৩ মার্চ ১৯৯৯। সকাল দশটা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছোট্ট অডিটোরিয়ামটি লেখক-কবিদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ। ভাবতেই পারিনি এত লেখক-কবির সমাগম হবে। আজ কবি আনওয়ার আহমদের ৫৮তম জন্মদিন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রূপম, কিছুধ্বনি-র সম্পাদক ও কবি আনওয়ার আহমদ আজ আর বেঁচে নেই। আমি ‘কাজীর কাগজ’-এর প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ করেছিলাম আনওয়ার আহমদের ওপর। দেশের প্রায় সব খ্যাতিমান লেখক-কবিই সেই সংকলনে লিখেছিলেন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন আসবেন তিনি। আমাদের পথপ্রদর্শক। কবি শামসুর রাহমান। যেহেতু অনুষ্ঠানটির আয়োজক ‘কাজীর কাগজ’, কাজেই আমি ব্যস্ত এর সকল আয়োজনের তদারকিতে। একপর্যায়ে আনওয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এত লোক কীভাবে এল? আনওয়ার ভাই তার চিরাচরিত ঝাঁজালো গলায় বললেন, খবর তো রাখো না। ১৩টা কাগজে নিউজ এসেছে। তখনই ফিরোজ আহমদ কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে অনুষ্ঠানে প্রবেশ করলেন। আমরা অনুষ্ঠান শুরু করলাম। মঞ্চে পাশাপাশি বসা কবি শামসুর রাহমান, কবি কায়সুল হক, কবি আনওয়ার আহমদ, শিল্পী বীরেন সোম ও আমি। অনুষ্ঠান শুরু হলো কবি শামসুর রাহমানের উদ্বোধনী বক্তৃতা ও কাজীর কাগজের মোড়ক উন্মোচনের মধ্য দিয়ে। তিনি আনওয়ার আহমদের দীর্ঘজীবন কামনার পাশাপাশি সম্পাদক হিসেবে তার সাফল্যের কথা বললেন। একে একে প্রায় ২৫ জন লেখক কবি বক্তৃতা করলেন। সবশেষে ফিরোজ আহমদ যখন আমার নাম ঘোষণা করলেন, আমি উঠে মাইকের সামনে গিয়ে কবি শামসুর রাহমানকে দ্বিতীয়বারের মতো বক্তৃতা করতে আমন্ত্রণ জানালাম। এতে তিনি কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন বলে মনে হলো। ইতস্তত করতে করতে তিনি উঠলেন এবং মাইকের সামনে গিয়ে হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, ‘আমি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছি কাজীর কাগজের সম্পাদক আমাকে কোনো দ্বিতীয়বার বক্তৃতা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আসলে আমার একটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। আমি প্রথমবার সদ্য প্রকাশিত এই কগজটি সম্পর্কে কিছুই বলিনি। সম্পাদককে ধন্যবাদ জানাই তিনি আমাকে ভুলটি সংশোধনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।’ এরপর তিনি কাজীর কাগজ সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলেন। মূলত প্রশংসাই করেন। এবং তিনি এ-ও বলেন, ‘এটি একটি ইতিহাস। এর আগে আমি আর কখনোই দেখিনি একজন কবির জন্মদিনে একটি কাগজ প্রকাশিত হয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে / সহজ কথা যায় না বলা সহজে।’ কবি শামসুর রাহমান সেই সহজ কথার, সহজ শব্দাবলির এক দক্ষ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন খুব কম বয়সেই। অত্যন্ত সহজ শব্দাবলিতে তিনি অবিরাম পয়ার রচনার এক দুর্লভ কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিলেন। তাঁকে যতবার, যে অবস্থাতেই দেখেছি সব সময়ই মনে হয়েছে তিনি একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে আছেন। সেই ঘোর কবিতার ঘোর। কবিতা-ই ছিল তাঁর চৈতন্যের ঘর-বাড়ি। তাঁকে কখনোই কবি ছাড়া আর অন্য কোনো কিছু মনে হয়নি। যখনই দেখি মনে হয় তিনি সেই অমিয় ঘোরের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। কাব্যদেবী তার রেশমি শুভ্র চুলে বিলি কাটছে। তিনি এক্ষুনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়বেন। বাংলা সাহিত্যে যোগ হবে আরও একটি অসাধারণ কবিতা। তাঁর চিন্তার বাগানে কবিতা ছাড়া আর অন্য কোনো স্বপ্নের বীজ প্রোথিত হয়নি।
তার অন্তিম ইচ্ছাটিও এটিই ছিল। আরও একটি পঙ্ক্তি রচনার ইচ্ছা। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি মাঝে-মাঝেই অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলতে চাইতেন। ইশারায় কাগজ-কলম চাইতেন রোগশয্যাপাশে শুশ্রূষারত প্রিয়জনদের কাছে কবিতা লেখার জন্য। শামসুর রাহমানের কবিতা আমাদের জন্য বিশ্বভ্রমণের একটি বিস্তৃত জানালা খুলে দেয়। আমরা ঘুরে আসতে পারি লোর্কার স্পেন, আরব্য রজনীর মরূদ্যানসহ সমগ্র বিশ্ব।
কবি শামসুর রাহমান বারবার, হাজার বার জানান দিয়েছেন তাঁর কবিতার শব্দের হৃদয়ে প্রোথিত দেশপ্রেমের চিরায়ত-শাশ্বত বাণী। কবির মৃত্যুর অব্যবহিত পরে জাতীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত নাগরিক শোকসভায় সৈয়দ শামসুল হক যথার্থই বলেছেন, কবি শামসুর রাহমান আমাদের স্বাধীনতার কবি। শামসুর রাহমান শুধু সমসাময়িক ও রাজনৈতিক ইস্যুর ওপর কবিতা লিখে চুপচাপ বসে থাকেননি, প্রতিটি চলমান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিয়েছেন সব সময়ই। এইখানেই কবি শামসুর রাহমান আর সবার চেয়ে আলাদা। আর তখনই তিনি হয়ে যান আমাদের হৃদয়ের কবি, আমাদের প্রাণের মানুষ।