The news is by your side.

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান: মার্কিন কম্পানির প্রস্তাব নিয়ে এগোচ্ছে সরকার

0 113

 

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কম্পানি এক্সন মবিল। তাদের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখছে সরকার। এক্সন মবিলের প্রস্তাব খতিয়ে দেখতে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। কমিটিতে আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী ও মধ্যস্থতাকারী, প্রযুক্তি বিষয়ে পরামর্শদাতার মতো বিশেষজ্ঞরা থাকবেন বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ দেখিয়ে এ পর্যন্ত দুই দফায় প্রস্তাব পাঠিয়েছে এক্সন মবিল। প্রথম দফায় গত মার্চে পেট্রোবাংলার কাছে প্রস্তাব পাঠায় তারা। সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ে আলোচনা হয় এবং এ নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য নীতিগত সম্মতি পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চার দিন আগে এক্সন মবিল আরেকটি প্রস্তাব পাঠায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে।

তেল-গ্যাস উত্তোলনে আন্তর্জাতিক কম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তিও (পিএসসি) সংশোধন করেছে সরকার। এতে অনুসন্ধানে পাওয়া গ্যাসের দাম আগের তুলনায় বাড়ানো হয়েছে। আগামী সপ্তাহে সংশোধিত পিএসসি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়ার কথা রয়েছে।

কমিটি গঠন ও পিএসসির বিষয়টি চূড়ান্ত হলে এক্সন মবিলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হবে বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

দেশের বিদ্যমান জ্বালানিসংকট আর ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার কারণে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের পরামর্শ দিয়ে আসছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। একইভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে বসিয়ে না রেখে স্থলভাগে ব্যাপক অনুসন্ধান শুরুর দাবিও ছিল তাঁদের। কারণ দেশের জ্বালানি খাত ক্রমেই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গতকাল রবিবার বলেন, ‘এক্সন মবিল আগে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। চার দিন আগে আরেকটি বিকল্প প্রস্তাব পাঠায় তারা।

এই বিষয়টি নিয়ে আমরা একটি কমিটি গঠন করতে যাচ্ছি। তারাও (এক্সন মবিল) চাচ্ছে এমন একটি কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসতে। আমরা এখন কমিটি বানানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। কমিটি গঠনের পর তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসব।’

প্রতিমন্ত্রী জানান, প্রথম প্রস্তাবে এক্সন মবিল গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোতে অনুসন্ধান চালানোর আগ্রহ জানিয়েছিল। এখন সেখান থেকে তারা সরে এসেছে। দ্বিতীয় প্রস্তাবে তারা গভীর সমুদ্রের ব্লকগুলোর বাইরেও কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে।

উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) সংশোধনের বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পিএসসি সংশোধন করা হয়েছে। এটি মন্ত্রিসভায় পাস হলেই আমরা এক্সন মবিলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করব। পিএসসি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো ফাইনাল সিদ্ধান্তে যাব না।’ তিনি বলেন, ‘এক্সন মবিলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে এখন আমাদের দুটি জিনিস করতে হবে। একটি পিএসসি চূড়ান্ত করা, অন্যটি কমিটি গঠন করা।’

 

সমুদ্রে যত ব্লক ও অনুসন্ধান

 

বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর অংশকে মোট ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অগভীর অংশে ব্লক আছে ১১টি। আর গভীর সমুদ্রে ব্লক আছে ১৫টি। অগভীর সমুদ্রের ব্লকে পানির গভীরতা ২০০ মিটার পর্যন্ত। এর বাইরের অংশ গভীর সমুদ্রের আওতায়। ব্লক ইজারা দেওয়ার পর সেখানে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু হবে।

এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার কম্পানি পসকো ইন্টারন্যাশনাল বঙ্গোপসাগরের একটি ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান করেছিল। কম্পানিটি বাণিজ্যিকভাবে আরো লাভজনক শর্ত যুক্ত করে পিএসসির মেয়াদ বাড়ানোর দাবি করেছিল। পেট্রোবাংলা রাজি না হওয়ায় কম্পানিটি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়।

এ ছাড়া মার্কিন কম্পানি কনোকোফিলিপস ও নরওয়েভিত্তিক স্ট্যাটঅয়েল যৌথভাবে সাগরে কয়েকটি ব্লকে অনুসন্ধানের কাজ পেয়েছিল। কিন্তু লাভজনক মনে না হওয়ায় তারা পিএসসি সই হওয়ার আগেই চলে যায়।

টিকে আছে শুধু ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি বিদেশ লিমিটেড (ওভিএল)। প্রতিষ্ঠানটি অগভীর সমুদ্রের ৪ নম্বর ব্লকে কাঞ্চন নামের এলাকায় অনুসন্ধান কূপ খনন করেছিল। কিন্তু তারা কোনো গ্যাস পায়নি বলে জানিয়েছে। এখন আরেকটি কূপ খননের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ অবস্থায় পিএসসি সংশোধন করে গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিদেশি কম্পানিগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হবে বলে আশা করছে পেট্রোবাংলা। কারণ গ্যাস উত্তোলন করা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশ থেকে অতিরিক্ত দামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হবে।

 

পিএসসি সংশোধন

 

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট-পিএসসি) প্রকৌশলী মো. শাহীনুর ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে পিএসসিতে গ্যাসের যে দাম ধরা হয়েছিল, তা আকর্ষণীয় ছিল না। যার কারণে বিদেশি কম্পানিগুলো গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আগ্রহী ছিল না। বিদেশি কম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে এখন পিএসসি সংশোধন করা হয়েছে। নতুন পিএসসিতে গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।

২০১৯ সালের মডেল পিএসসি অনুযায়ী, অগভীর ও গভীর সমুদ্রের প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৫.৬ ও ৭.২৫ ডলার। সংশোধিত পিএসসিতে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ড ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান, অর্থাৎ বিশ্ববাজারে ক্রুডের দাম ১০০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ১০ ডলার।

বর্তমান পিএসসি অনুসারে অগভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাসে বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং গভীর সমুদ্রে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ রয়েছে। সংশোধিত পিএসসির খসড়ায় বাংলাদেশের হিস্যার অংশ অগভীর সমুদ্রে ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ এবং গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কম্পানিগুলোকে (আইওসি) আকৃষ্ট করার জন্য মডেল পিএসসি সংশোধন করে সরকার। সংশোধিত পিএসসির খসড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন। এখন এটি মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের পর পিএসসি চূড়ান্ত করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার নিয়ম।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, এক্সন মবিলসহ একাধিক আইওসি দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। তবে মার্কিন কম্পানি এক্সন মবিলকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ বিধানের আওতায় দরপত্র ছাড়া অনুসন্ধানের কাজ দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

পেট্রোবাংলাকে দেওয়া এক্সন মবিলের প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারের অনুমোদন পেলে শুরুতে সংশ্লিষ্ট ব্লকগুলোতে টুডি সিসমিক সার্ভে চালানো হবে। এতে সময় লাগবে দুই বছর। এরপর থ্রিডি সিসমিক তথ্য সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণের কাজটি সম্পন্ন করা হবে পরবর্তী তিন বছরে। এ জন্য সরকারের সঙ্গে একটি পিএসসি সইয়ের কথা বলা আছে প্রস্তাবে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘সংশোধিত পিএসসি আগামী সপ্তাহে মন্ত্রিসভায় উঠতে পারে। তারপর এক্সন মবিলের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা যাবে। তার আগে প্রস্তাবের বিষয়গুলো নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে চাই না।’

 

বিশেষজ্ঞ মত

 

দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে উচ্চমূল্যে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। স্থলভাগেও কমছে নিজস্ব গ্যাসের মজুদ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও অনুসন্ধানে এত দিন কার্যকর কোনো উদ্যোগ ছিল না। পাশের দেশ মিয়ানমার ও ভারত তাদের প্রান্তে সাগরে তেল-গ্যাস আবিষ্কারে অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছে। সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে দেশ গ্যাস সংকটে পড়তে পারে। কারণ আমদানি করে গ্যাসের পুরো চাহিদা মেটানো অসম্ভব।

 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে দেশে যে জ্বালানিসংকট চলছে, সেটা আগামী দিনে আরো বাড়বে বলে মনে হয়। কারণ এটা সমাধানের জন্য প্রয়োজন জ্বালানির জোগান। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে অনুসন্ধান কার্যক্রম সেভাবে করা হয়নি। বিশেষ করে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান একেবারেই করা হয়নি। তিনি বলেন, যেহেতু এক্সন মবিল কম্পানি গভীর সমুদ্রে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশের স্বার্থেই তাকে দিয়ে এই কাজটি করানো উচিত। কারণ এক্সন মবিল খুবই উচ্চমানের বহুজাতিক কম্পানি। তাদের গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই সরকারের উচিত এক্সন মবিলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেশের জন্য যেটা ভালো হয় সেভাবে চুক্তি করা। কারণ এক্সন মবিলের মতো বড় প্রতিষ্ঠান বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানে কাজ শুরু করলে বিশ্বের অন্য বড় প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.