নিজের বিতর্কিত ও অসম দাম্পত্য জীবন নিয়ে বই লিখেছেন এক ব্যক্তি। অমর একুশে বইমেলায় বিক্রির জন্য তা প্রদর্শিত হচ্ছে। তবে স্ত্রীসহ মেলায় এসে হেনস্তার শিকার হয়েছেন ওই লেখক। সদ্য বিবাহিত ওই দম্পতির ‘অপরাধ’ তাদের দুজনের মধ্যে বয়সের বিস্তর ব্যবধান।
আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে উঠে আসা ওই বইয়ের লেখক মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির প্রাক্তন সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ। তার লেখা বই দুটির নাম ‘তিশার ভালোবাসা’ ও ‘তিশা অ্যান্ড মুশতাক’। মুশতাক ও তিশা দম্পতির জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা এই বই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। নেটিজেনদের মধ্যে বিতর্ক ও উৎসাহ দুইই দেখা গেছে এই বই ও দম্পতিকে নিয়ে। শুক্রবার তাদের দুজনকে ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ বলে বইমেলা থেকে বের করে দেয় মেলার একদল দর্শনার্থী।
কেন এই দম্পতি এতটা আলোচিত?
এ ঘটনার সূত্রপাত ২০২৩ সালে। ঢাকার মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন খন্দকার মুশতাক আহমেদ। ২০২৩ সালের মে মাসে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশার সাথে মুশতাকের দুটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ছাত্রীর সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের প্রবীণ সদস্যের সম্পর্কের বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। পরে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়।
এ ছাড়া ১ জুন অভিভাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রোস্তম আলী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ষাটোর্ধ্ব মুশতাক অভিভাবকদের চাপে ওই ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। এটি তার তৃতীয় বিয়ে।
এরপর তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ মুশতাক আহমেদ এবং কলেজ অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলার আবেদন করেন। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ৮ আগস্ট গুলশান থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় মুশতাকের সঙ্গে কলেজটির অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীকেও আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে বাদী ও কলেজছাত্রীর মা উল্লেখ করেন, তার মেয়ে মতিঝিল আইডিয়ালের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। মুশতাক সেই ছাত্রীকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন এবং এক পর্যায়ে কুপ্রস্তাব দেন। এ বিষয়ে বাদী ফাওজিয়া রাশেদীর কাছে প্রতিকার চাইতে গেলেও কোনও সহযোগিতা পাননি বরং মুশতাককে অনৈতিক সাহায্য করে আসতে থাকেন তিনি। বাদী উপায় না পেয়ে গত ১২ জুন ভুক্তভোগীকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িতে নিয়ে গেলে মুশতাক তার লোকজন দিয়ে ভুক্তভোগীকে অপহরণ করেন। পরে বাদী জানতে পারেন মুশতাক ভুক্তভোগীকে একেক দিন একেক স্থানে রেখে অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছেন এবং যৌন নিপীড়ন করছেন।
মামলার করার পর ১৭ আগস্ট বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ মুশতাককে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন দেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক বেগম মাফরোজা পারভীনের আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন তিনি।
১৪ নভেম্বর মামলার দায় থেকে ওই দুইজনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা।
ইতোমধ্যে ২৪ আগস্ট আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন মুশতাক।
মুশতাক-তিশার অসম বিয়ে নিয়ে এই বিতর্ক অনেকদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচিত ছিল। এই আলোচনার সুযোগ নিয়েই বই বের করেন মুশতাক। হয়তো ভেবেছিলেন তাদের ঘটনা পড়তে ইচ্ছুক হবে অনেকেই। এবং তা হতেও চলেছিল। শুক্রবার যখন মুশতাক ও তিশা মিজান পাবলিশার্সের সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলোর প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখন বেশকিছু উৎসাহী দর্শনার্থীদের ভিড় জমে যায়। তবে এক পর্যায়ে তাদের ‘ভুয়া ভুয়া’ ও ‘ছি ছি ছি ছি’ দুয়োধ্বনি দিতে থাকেন জনতা। অবস্থা বেগতিক দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সহায়তায় তারা বইমেলা থেকে বের হয়ে যান।
এ ঘটনাটিও যথেষ্টই আলোচনায় চলে এসেছে, তবে এ ব্যাপারে দুটো মতবাদ দেখা গেছে। ব্যাপারটা কি ঠিক হলো, নাকি হলো না?
প্রথমত, নিঃসন্দেহে মুশতাক ও তিশার অসম বিয়েটি বিতর্কিত। তবে তারা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং বিয়েটাও আইনত বৈধ। কিন্তু বড় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ষাটোর্ধ্ব মুশতাক এবং সে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী সদ্য কৈশোর পেরোনো তিশার বিয়ে আইনগত হলেও কতটা নৈতিক, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বটে। কেননা, বিষয়টার শুরু হয়েছিল অপহরণ দিয়ে। অপহরণ করে বিয়েতে বাধ্য করা কি নৈতিক?
দ্বিতীয়ত, বইমেলায় কেউ নিজের খরচে বই প্রকাশ করলো কি না, তার পেছনে উদ্দেশ্যটি সৎ নাকি অসৎ, তা আসলে বিচার করা কঠিন। নিজ খরচে অখ্যাত বা স্বল্পখ্যাত লেখকের বই প্রকাশের ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। লেখক বই লিখতেই পারেন, আর প্রকাশক টাকা বা প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে তা প্রকাশ করতেও পারেন। এই বই প্রচার করতে গেলে দর্শকদের আসলে তা ঠেকানোর কোনো জায়গা নেই। বইয়ের বিষয়বস্তু অখাদ্য হলে তা বর্জন করার দায়িত্ব একমাত্র পাঠকেরই।
তৃতীয়ত, পড়ার অযোগ্য বই যে প্রতিবছরই বইমেলায় দেখা যায়, তা কারোই অজানা নয়। এবং সেসব বইয়ের লেখকরা দর্শনার্থীদের ধরে ধরে সে বই বিক্রির চেষ্টাও করেন অহরহই। তবে তাদেরকে সাধারণত এভাবে বইমেলা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় না। মুশতাক-তিশার অতীত সবার পরিচিত, এ কারণেই বোধহয় তাদের সম্পর্ক নিয়ে লেখা বইগুলো মানুষকে এতটা ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
মুশতাক ও তিশাকে জোরপূর্বক বইমেলার মতো সার্বজনীন একটি এলাকা থেকে বের দেওয়ার ঘটনাটা অনেকের পছন্দ হয়েছে। আদতে কিন্তু এতে ওই দম্পতিকে আরও উপকার করা হলো। তারা এ বিষয়টিকে পুঁজি করে এখন আরেকটু ‘জনপ্রিয়তা’ আদায় করে নেবেন।