The news is by your side.

পশ্চিমা অস্ত্রের পরীক্ষাগার ইউক্রেন!

0 98

গত বর্ষায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কাউন্টার অ্যাটাকে ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছিল ইউক্রেন। এ সাফল্যের মূলে ছিল মার্কিন কামান এবং রকেটের ব্যবহার। একইসঙ্গে ইউক্রেনও যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি কিছু কামান ও টার্গেটিং সিস্টেমকে উন্নত করেছে। যা রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করতে সহায়তা করেছে।

যুদ্ধ চলাকালে ইউক্রেনীয়রা নির্ভুলভাবে লক্ষ্যভেদ করার জন্য একটি সফটওয়্যার তৈরি করে। যা ট্যাবলেট কম্পিউটার ও স্মার্টফোনে ব্যবহার করা যায়। এরপর থেকেই অ্যাপটি ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। অ্যাপটি স্যাটেলাইট ও অন্যান্য উৎস থেকে শত্রুপক্ষের কোনো অবস্থানের ছবি সংগ্রহ করে সেগুলোকে রিয়েল-টাইম টার্গেট হিসেবে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করে। সেগুলোর বিষয়ে নির্ভুল তথ্য দিতে পারে।

অ্যাপটি ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে প্রয়োজনের খাতিরে উদ্ভাবিত উপকরণগুলোর একটি উদাহরণ মাত্র। এমন কয়েক ডজন অ্যাপ, অস্ত্র তৈরি করেছে ইউক্রেন। উন্নত করে নিয়েছে পুরোনো ঘরানার অনেক অস্ত্রই। এ ছাড়া যেসব অস্ত্র মেরামত করতে ব্যাপক খরচ হতো সেগুলোরও স্বল্প ব্যায়ে মেরামতের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তারা।

প্লাস্টিকে তৈরি ড্রোন। খুব সামান্য শব্দ করা এসব ড্রোন লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ফেলে আসতে বেশ কার্যকর। আছে থ্রিডি প্রিন্টার। যা অনেক সময় ভারী অস্ত্রশস্ত্র মেরামতের প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে। কেবল তাই নয়, ইউক্রেনের প্রকৌশলীরা সাধারণ পিকআপ ট্রাককে মিসাইল লঞ্চারে পরিণত করেছেন। রাশিয়ার তৈরি পুরোনো আমলের মিগ-২৯ বিমানে কীভাবে অত্যাধুনিক মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র জুড়ে দেয়া যায় সেটাও আবিষ্কার করেছেন।

এর বাইরেও ইউক্রেনীয়রা সোভিয়েত আমলের রকেটের নকশার ওপর ভিত্তি করে অ্যান্টি-শিপ ক্ষেপণাস্ত্রও বানিয়েছে। যেগুলো ২০০ মাইল দূর থেকেও রুশ নৌবহরকে আঘাত করতে সক্ষম। ইউক্রেনীয়দের এমন উদ্ভাবনী দক্ষতায় রীতিমতো মুগ্ধ মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা। ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন তারা।

তবে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত না থাকায় মার্কিন কর্মকর্তারা জানেন না ইউক্রেনীয়দের ঘরে তৈরি অস্ত্র, অন্যান্য সামরিক উপকরণ এবং নিজেদের পাঠানো অস্ত্রগুলো কতটা কার্যকর। কিন্তু ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সে বিষয়ে নিজেদের জানার পরিধি আরও বাড়িয়ে নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো।

বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন এখন প্রকৃতপক্ষে একটি ‘ব্যাটল ল্যাবে’ পরিণত হয়েছে। যা যুদ্ধক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক সহজলভ্য এবং কার্যকর সমাধান দিতে সক্ষম।

বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মার্কিন থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক সেথ জোনস বলেন, তাদের উদ্ভাবনী সক্ষমতা এক কথায় অবিশ্বাস্যভাবে অসাধারণ।

ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল ইউক্রেনীয়দের সামরিক উদ্ভাবনী সক্ষমতাকেই বাড়ায়নি, এ যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের সামনে দারুণ আরেকটি সুযোগ হাজির করেছে। বাস্তব যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাদের অস্ত্র কতটা কার্যকর তা যাচাই করা যেতে পারে ইউক্রেনে। একইসঙ্গে জয়ী হতে কোন পক্ষ কী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে তাও দেখার দুর্দান্ত সুযোগ এটি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাশাসনিক ও সামরিক কর্মকর্তারা এরই মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনে কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছে, কীভাবে ব্যবহার করেছে, কেন ব্যবহার করেছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। সব মিলিয়ে ইউক্রেন যেন নতুন-পুরোনো অস্ত্রের পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে এক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ইউক্রেন সব দিক থেকেই অস্ত্রের পরীক্ষাগার হিসেবে হাজির হয়েছে। কারণ এসব অস্ত্র এর আগে কখনোই দুটি শিল্পোন্নত দেশের মধ্যকার যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়নি।’

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেন ও রাশিয়ার সমরাস্ত্রের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের অন্যতম বড় জায়গা। যা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সমরাস্ত্র উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ তুলনামূলক তথ্যের যোগান দিচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বেশ কিছু সুইচব্লেড-৩০০ সিরিজের ড্রোন দিয়েছিল। দিয়েছিল প্রতিপক্ষের রাডার ধ্বংসে সক্ষম কিছু ক্ষেপণাস্ত্রও। এসব সমরাস্ত্র তৈরির সময় যতটা কার্যকর ভাবা হয়েছিল বাস্তবে ততটা কার্যকারিতা দেখাতে পারেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এম-১৪২ মাল্টিপল রকেট লঞ্চার কিংবা হিমার্সের মতো ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাগুলো যথেষ্ঠ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। একইসঙ্গে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও নানাবিধ দুর্বলতা চিহ্নিত করতেও সহায়তা করেছে এই যুদ্ধ।

এ বিষয়ে এক মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেনীয়রা এই যুদ্ধে যেভাবে রুশ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, অস্ত্রাগার ধ্বংস করতে হিমার্স ব্যবহার করেছে তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়া মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘অথচ আমাদের বিশেষজ্ঞরা এর কার্যকারিতা জানতে বছরের পর বছর ব্যয় করেছেন গবেষণায়।’

এই যুদ্ধ মার্কিনিদের এম-৭৭৭ হাউটজারের ত্রুটি খুঁজে বের করতেও সহায়তা করেছে। এ বিষয়ে আরেক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, একটানা গোলাবর্ষণ করলে অল্প সময়ের মধ্য এর ব্যারেল উত্তপ্ত হয়ে বেঁকে যায়। নির্ভুল লক্ষ্যভেদ কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দেখা যাচ্ছে, নির্মাণের সময় এটিকে যতটা নিখুঁত ভাবা হয়েছিল বাস্তবে ততটা নয়।

ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিনিদের জন্যও একটি বাস্তব পরীক্ষা ক্ষেত্র। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ও হাউস ইন্টেলিজেন্স কমিটির সদস্য জিম হাইমসের মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, যদি এই যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলা হয়, তবে তা নিয়ে একটি গোটা বই লেখা যাবে।

কেবল বিদ্যমান অস্ত্রের পরীক্ষা নয়, নতুন নতুন অস্ত্রের ধারণা লাভ, উন্নয়ন, সেগুলোর পরীক্ষা চালানো এবং বাজার তালাশের আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছে ইউক্রেনের মাটি। ব্রিটিশ অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিএই সিস্টেমস এরই মধ্যে জানিয়েছে, কামিকাজে রাশিয়ার সফল ড্রোন ব্যবহারের পর এ ধরনের উন্নত ড্রোন বানানোর পরিকল্পনা করেছে তারা। যা একইসঙ্গে শত্রুকে আক্রমণ করবে এবং নিজ পক্ষের সেনাদের শত্রুর আসন্ন আক্রমণ থেকেও রক্ষা করবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জিওস্প্যাশিয়াল-ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিও এ ধরনের ড্রোন বানানোর চিন্তা ভাবনা করছে। এর প্রধান অ্যাডমিরাল রবার্ট শার্প গর্বভরে বলেছিলেন, ইউরোপে মিত্রদের কাছে এই ধরনের কিছু ড্রোন পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্য। তবে সেগুলো ইউক্রেনে পরীক্ষা করা হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। গত বসন্তে ডেনভারে এক স্যাটেলাইট সম্মেলনের ফাঁকে রবার্ট শার্প সিএনএনকে তাদের ডেভেলপ করা ড্রোন সম্পর্কে বলেন, ‘এটি (ড্রোন) আপনাকে মেঘের ওপর দিয়ে গিয়ে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার সুযোগ দেয়।’

সব মিলিয়ে, ইউক্রেন পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই রাশিয়ার জন্যও নিজ নিজ ভান্ডারে থাকা অস্ত্রের কার্যকারিতা, সেগুলোর উন্নয়ন, সেগুলোর মেরামত, প্রতিপক্ষের অস্ত্রের বিষয়ে নতুন নতুন ব্যবহারিক তথ্য আহরণ করার সুযোগ তৈরি করেছে। যা আধুনিক জামানার যুদ্ধকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে করে তুলতে পারে আরও বেশি জটিল।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.