ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হক একই সঙ্গে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দ্বৈত নাগরিক। শামীম হক নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বলে দাবি করে নথি জমা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে (ইসি)। সব নথি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, নথিতে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহারে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। শামীম হকের নেদারল্যান্ডসের পাসপোর্ট নম্বর BY6০F০J74 আর বাংলাদেশের পাসপোর্টের নম্বর BGD A00218161
শামীম হক ইসিতে দাবি করেছেন, তিনি গত ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করেছেন। সেই আবেদন কার কাছে করা হয়েছে, তা নথিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। উল্লিখিত নথি অনুযায়ী নাগরিকত্ব ত্যাগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার দূতাবাস থেকে ফিরতি ই-মেইলে ‘হল্যান্ড পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের’ নির্দেশনার জন্য অপেক্ষার কথা জানানো হয়। আদতে ‘হল্যান্ড পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়’ বলে কিছু নেই। আর নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের বিষয়টি সেদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেখে না, এ বিষয়ে কাজ করে মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস অ্যান্ড সিকিউরিটি অব দ্য নেদারল্যান্ডস।
দ্বিতীয়ত, ই-মেইলে ইংরেজির যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা এতই দুর্বল, যা কোনো বিদেশি দূতাবাসের কাছ থেকে সহসা প্রত্যাশা করা যায় না। নথিতে এটি প্রমাণ হয় না যে এই ই-মেইল দূতাবাস থেকে পাঠানো হয়েছে।
নাগরিকত্ব বাতিল চেয়ে ইসিতে যে নথি জমা দেওয়া হয়, তাতে বহু স্থানে ই-মেইল যোগাযোগের বেশির ভাগ সময় ৪ ডিসেম্বরের পরে। কিন্তু প্রতিটি ই-মেইলে ৯ নভেম্বর নেদারল্যান্সের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি শামীম হকের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়। নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব ত্যাগ করার আবেদন করা নথি দূতাবাসসহ দায়িত্বশীল কারও গ্রহণ করার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।
শামীম হক দ্বৈত নাগরিক হওয়ায় বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) ইসিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে তাঁর প্রার্থিতার বৈধতা নিয়ে শুনানি হয়। পরে শুনানি স্থগিত রেখে ইসি শুক্রবার (১৫ ডিসেম্বর) রায়ের দিন নির্ধারণ করেছে। আইন অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিক প্রমাণ হলে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
সব নথি পর্যালোচনা করে জানা গেছে, শামীম হকের হয়ে বিভিন্ন জায়গায় যে ই-মেইল করা হয়েছে, তা করেছেন আলী আজগর মানিক নামের এক ব্যক্তি। মানিকের এইচসিএইচ আন্ডারস্কোর বিডি অ্যাট ইয়াহু ডটকম (hch_bd@yahoo.com) ঠিকানা থেকে করা ই-মেইলে নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসে যোগাযোগ করে শামীম হকের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি বারবার উপস্থাপন করা হয়।উল্লিখিত ই-মেইলে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়।
মানিকের ওই ই-মেইলটিতে খুঁজে পাওয়া যায় ‘হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস’ নামে একটি এতিমখানার ঠিকানা। সেখান থেকে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় আলী আজগর মানিকের। এ বিষয়ে জানতে মানিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি দূতাবাসের কোন পদে কর্মরত। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ডাচ দূতাবাসে কাজ করব কেন? আমাদের দূতাবাসের সঙ্গে কিছু প্রকল্প রয়েছে, যেমন– হল্যান্ড চিলড্রেন হাউস। এর ফলে দূতাবাসের সঙ্গে ই-মেইলে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমি দূতাবাসের কোনো পদে নেই।’
তাহলে ইসিতে জমা দেওয়া নথিতে ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের কনস্যুলার সেবার ঠিকানা, দূতাবাসের লোগো, ফোন নম্বর, ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের ঠিকানা ব্যবহার করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হল্যান্ড চিলড্রেন হাউসে দূতাবাসের কূটনীতিকসহ রাষ্ট্রদূত একাধিকবার এসেছেন। সে কারণে তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। তবে দূতাবাসের কোনো কিছু ব্যবহার করা হয়নি বলে তিনি দাবি করেন।
মানিক বর্তমানে ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ আলীপুরে কবি জসীম উদ্দীন সড়কের ১০ তল ভবন রাজ্জাক টাওয়ারে বসবাস করছেন।
শামীম হকের নাগরিকত্ব কি বাতিল করে দিয়েছে নেদারল্যান্ডস? এমন প্রশ্নের জবাবে মানিক বলেন, বাতিল হতে ১০-১১ মাস সময় লাগে। নাগরিকত্ব বাতিলের আবেদন ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসে করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
আলী আজগর মানিক কে? জানতে চাইলে শামীম হক বলেন, হল্যান্ড চিলড্রেন হাউসের দেখভাল করেন তিনি। দূতাবাসের নাম ব্যবহার করে মানিককে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগের নির্দেশনা কে দিয়েছে– তা জানতে চাইলে শামীম হক বলেন, ‘কনস্যুলারে ওগুলো পাঠানো যায় না। ওগুলো আমিই তাকে বলেছি। যে ই-মেইল থেকে পাঠানো হয়েছে, সেটি আমার প্রতিষ্ঠানের ই-মেইল।’