গত এক বছরে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেটে বৈশ্বিক অবস্থান ও গতি কিছুটা বাড়লেও ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পিছিয়ে পড়েছে। ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতি গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু বৈশ্বিক অবস্থান আরো নিচে নেমেছে।
মোবাইল ইন্টারনেটে গত বছরের এপ্রিল মাসে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯তম। চলতি বছরের এপ্রিলে ১৩৮টি দেশের মধ্যে এই অবস্থান হয়েছে ১১৮তম। তবে বৈশ্বিক পর্যায়ে যেখানে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় গতি ডাউনলোডের ক্ষেত্রে ৪২.০৭ এমবিপিএস, সেখানে বাংলাদেশে ১৬.৪৭ এমবিপিএস। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় গতি গত বছরের তুলনায় ০.৫৩ এমবিপিএস বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ০.১৮ এমবিপিএস কমেছে।
মোবাইল ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নিচের অবস্থানে রয়েছে আফগানিস্তান (১৩৭), নেপাল (১২৪), শ্রীলঙ্কা (১২১) ও পাকিস্তান (১২০)। আর ওপরের অবস্থানে রয়েছে ভারত (৬০)।
ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে গত বছরের এপ্রিলে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৫তম। এ বছর এপ্রিলে সেই অবস্থান থেকে নিচে নেমে ১০৭তম হয়েছে। মার্চ মাসেও বাংলাদেশের এই অবস্থান ছিল ১০৪তম। আবার বৈশ্বিক পর্যায়ে যেখানে ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গড় ডাউনলোড গতি ৮০.১২ এমবিপিএস, সেখানে বাংলাদেশে ৩৫.৯৬ এমবিপিএস।
ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপরের অবস্থানে রয়েছে নেপাল (৮১) ও ভারত (৮৩)। নিচের অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান (১৪৯), ভুটান (১৪৮) ও শ্রীলঙ্কা (১৩১)।
তথ্য বৈশ্বিক পর্যায়ে ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওকলার। গতকাল মঙ্গলবার তাদের এই মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের দেশগুলোর গড় ইন্টারনেট গতির তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে এই প্রতিষ্ঠান। এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে পরবর্তী মাসের মাঝামাঝিতে সূচক প্রকাশ করে তারা।
মোবাইল ইন্টারনেটে সেরা ও সর্বনিম্ন : ওকলার তথ্য অনুসারে মোবাইল ইন্টারনেটে সর্বোচ্চ ১৮৯.৯৮ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে কাতার। এরপর ১৭৫.৩৪ থেকে ১০৯.০৩ এমবিপিএস গতি নিয়ে শীর্ষ আরো ৯টি দেশের মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ম্যাকাও, কুয়েত, নরওয়ে, ডেনমার্ক, বাহরাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও নেদারল্যান্ডস। আর সবচেয়ে কম ৩.৯৮ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি নিয়ে তালিকার সব শেষে অবস্থান ইয়েমেনের। এরপর ৪.৪৬ থেকে ১১.৩৮ এমবিপিএস গতি নিয়ে রয়েছে ইয়েমেন, আফগানিস্তান, কিউবা, ভেনিজুয়েলা, হাইতি, বলিভিয়া, সোমালিয়া, ঘানা, সিরিয়া ও তাজিকিস্তান।
ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সেরা ও সর্বনিম্ন : ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে সর্বোচ্চ ২৪২.৩১ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি নিয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। এরপর ২২২.৪৯ থেকে ১৭৪.২৬ এমবিপিএস গতি নিয়ে শীর্ষ আরো ৯টি দেশের মধ্যে রয়েছে চিলি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, স্পেন ও রুমানিয়া। আর সবচেয়ে কম ১.৯৭ এমবিপিএস ডাউনলোড গতি নিয়ে তালিকার সবচেয়ে নিচে অবস্থান কিউবার। এরপর ২.৩১ থেকে ৫.৪৪ এমবিপিএস গতি নিয়ে নিচে অবস্থানের আরো ৯টি দেশ হচ্ছে কিউবা, আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, ইয়েমেন, পূর্ব তিমুর, বুরুন্ডি, জাম্বিয়া, নাইজার ও সুদান।
দেশে ইন্টারনেট নিয়ে অস্বস্তি, অভিযোগ এখনো বহাল। ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে ইন্টারনেট সেবার মান সেভাবে বাড়ছে না। বড় শহরগুলোর বাইরে পরিস্থিতি আরো নেতিবাচক। উপকূল ও চরাঞ্চলের অনেক স্থানে ইন্টারনেট তো দূরের কথা, মোবাইল ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রেও গ্রাহক ভোগান্তি দূর হয়নি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কালের কণ্ঠ’র নিজস্ব সংবাদদাতারা এ পরিস্থিতির তথ্য জানিয়েছেন। মোবাইল ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়েও গ্রাহকদের অভিযোগ রয়েছে।
ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় পেশিশক্তির দাপটের অভিযোগ তুলেছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারদের সংগঠন আইএসপিএবি। সংগঠনটির সভাপতি ইমদাদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, লাইসেন্স ছাড়াই অনেকে পেশিশক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে চার ক্যাটাগরিতে বৈধ আইএসপির সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। আর অবৈধদের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তাদের কাছে লাইসেন্সধারীরা অনেকটা অসহায়। লাইসেন্সধারীদের অনেকে তাদের কাছে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকের সক্ষমতা থাকার পরও তাদের আইএসপি লাইসেন্স আপগ্রেড না করার কারণে সেবার এলাকা বাড়ানো যাচ্ছে না। বিটিআরসি এই অবৈধদের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে অভিযান চালায়, কিন্তু তাতে পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে না।
দেশের সব এলাকায় আপনাদের সেবা কি আছে—এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছু এলাকা, যেখানে ফাইবার অপটিক নেই সেসব এলাকায় সেবা নেই। তবে দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করছি। বিটিআরসির সোশ্যাল অবলিকেশন ফান্ডের মাধ্যমে বিটিসিএল ওই সব এলাকায় ফাইবার অপটিকের ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ করছে। আবার যেখানে হাওর, খাল-বিলের কারণে ফাইবার অপটিক নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা চালু করা হচ্ছে।’
মোবাইল ইন্টারনেট বৈশ্বিক পর্যায়ের গড় গতির তুলনায় কেন পিছিয়ে রয়েছে—এই প্রশ্নে মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন এমটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অব.) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেকোনো কারিগরি প্রযুক্তির মান উন্নয়নের কোনো সীমা নেই। আমাদের অপারেটরগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছে মানসম্পন্ন সেবা পৌঁছে দিতে প্রতিনিয়তই বিনিয়োগ করে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশে মোবাইল সেবার খরচ বিশ্বের সবচেয়ে কম যে কয়টি দেশ তার একটি। যদিও এখানে কর প্রায় সবচেয়ে বেশি। সেবার মান উন্নতিকল্পে বিনিয়োগবান্ধব নীতি গ্রহণ ও বিনিয়োগের বিপরীতে আয় নিশ্চিত করা দরকার। এ ছাড়া মোবাইল খাতের করব্যবস্থা যৌক্তিক করা প্রয়োজন।’
বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ নিয়ে ভোগান্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, প্যাকেজগুলো করা হয় গ্রাহকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ওকলার প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেন, ‘তারা কাকে জিজ্ঞেস করে কিভাবে এই প্রতিবেদন করে তা আমার জানা নেই। ইন্টারনেট সেবায় দেশ কতটা এগিয়েছে, তা বুঝতে হলে ২০০৮ সালের অবস্থার সঙ্গে ২০২৩ সালের অবস্থার তুলনা করতে হবে। দেশের ৯৮ শতাংশ এলাকা এখন ফোরজি কাভারেজের মধ্যে রয়েছে। ইন্টারনেটের দাম ২০০৮ সালের তুলনায় বহুগুণ কমেছে। তা ছাড়া ৫জি সেবার প্রস্তুতি চলছে। উপকূলীয় এলাকায় যেখানে জীবনধারণই কষ্টকর, সেখানে উচ্চগতির ইন্টারনেটের প্রত্যাশা পূরণ করাটা পরিশ্রম ও সময়সাধ্য এবং ব্যয়সাপেক্ষ। তবে সরকার চেষ্টা করছে। অনেক প্রকল্প চলমান। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোনো এলাকা থেকেই ইন্টারনেট সেবা নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না।’
ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে পেশিশক্তির দাপটের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, লাইসেন্স ছাড়া কেউ এই সেবা দিতে পারবে না। অবৈধ যারা রয়েছে তাদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি আইএসপিএবিকেই করতে হবে। সেই তালিকা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।