দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ১১টি উৎস চিহ্নিত করেছে । এগুলো বন্ধে ২৫ দফা সুপারিশও করে সংস্থাটি। কেনাকাটা, টেন্ডার, সেবা, নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, ইকুইপমেন্ট ব্যবহার ও ওষুধ সরবরাহসহ বিভিন্ন খাতে কী ধরনের দুর্নীতি হয় তা তুলে ধরা হয়।
চিহ্নিত উৎসগুলো দ্রুত বন্ধে তৈরি সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন রাষ্ট্রপতিকেও দিয়েছে দুদক। কিন্তু সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দুদক যে ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল তাদের কাজ দেয়াও বন্ধ হয়নি।
মহাপরিচালক আবুল কালাম বিদায় নিলেও রেখে গেছেন দুর্নীতির নানা কীর্তি। এসবের সঙ্গে তিনি একা জড়িত নন। মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একজন তৃতীয় শ্রেণির হিসাবরক্ষক আবজাল পর্যন্ত এর ঢালপালা ছড়িয়েছে।
হাতেগোনা কয়েকজন দুর্নীতি থেকে দূরে থাকলেও সিস্টেমের কারণে তারাও আটকা পড়েছেন। দুদক গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছে। প্রতিবেদনের আলোকে নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ার উদ্যোগ নেয়া হলে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হতো।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি নানা রকমের দুর্নীতি স্বাস্থ্যসেবাকে কলঙ্কিত করছে। এ কলঙ্কের দাগ অনেকের গায়েই আছে।
এতদিন এ দাগ বা ক্ষত কিছুটা আড়ালে থাকলেও করোনা তা সামনে নিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা অনেক আগেই স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করেছিলাম।
নিয়োগ ও বদলি থেকে শুরু করে কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ করা এমনকি একজন চিকিৎসকের কাছে জনগণ কী ধরনের সেবা পাবেন সেই কথাও বলেছি।
আমাদের সুপারিশ প্রথমে মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়ে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ করেছি। পরে আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তা রাষ্ট্রপতিকেও অবহিত করেছি।
দুদকের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতের ১১টি দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এগুলো প্রতিরোধে ২৫ দফা সুপারিশও করা হয়। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতের নিয়োগ, বদলি কেনাকাটাসহ এ সংক্রান্ত কাজে নীতিমালা মানা হয় না। স্বার্থান্বেষী মহল রয়েছে এর পেছনে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতাধীন বিভিন্ন হাসপাতালে সংঘবদ্ধ একটি চক্র গড়ে উঠেছে। সমাজের এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি যথাযথ সরঞ্জাম না থাকা সত্ত্বেও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সহযোগিতায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করেছে।
হাসপাতালগুলোতে সরকারি ওষুধ থাকার পরও তা রোগীদের দেয়া হয় না। পরে ওষুধ কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়া হয়। দুর্নীতিটা এখানেই শেষ নয়, এ চুরির হিসাব রেজিস্টারে মিলিয়ে রাখা হয়।
বেআইনি প্রভাবে নিুমানের ও অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন প্রকিউরমেন্টে যুক্ত সিএমএসডিতে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে।
এসব দুর্নীতি ঠেকাতে ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট ক্রয়ে গঠিত কমিটিতে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করে দুদক। দক্ষ জনবল না থাকলে ইকুইপমেন্ট না কেনার কথাও বলা হয় সুপারিশে।
এতে ওষুধ ও মেডিকেল ইকুইপমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে ইজিপিতে টেন্ডার আহ্বান এবং পিপিআরের বিধান নিশ্চিত করতে বলা হয়। হাসপাতাল পর্যায়ে যন্ত্রপাতি কেনাকাটা ও তা গ্রহণ করার বিষয়ে গঠিত কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখার প্রস্তাব করা হয়।
তাদের মাধ্যমে সব কিছু নিশ্চিত হয়ে যন্ত্রপাতি কেনা ও গ্রহণ করার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে সরকারের কোটি কোটি টাকা নষ্ট না করতে বলা হয়। দুদকের সুপারিশে আরও বলা হয়, সব হাসপাতালে জরুরি হটলাইন, পরামর্শ ও অভিযোগ কেন্দ্র এবং যোগাযোগের সার্বক্ষণিক ব্যবস্থা রাখতে হবে।
হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিভাগের সব দফতর-অধিদফতরের সামনে সিটিজেন চার্টার রাখার কথা বলা হয়।
এছাড়া প্রশাসনিক সুবিধার্থে স্বাস্থ্য অধিদফতর ভেঙে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা নামে আলাদা দুটো অধিদফতরের প্রস্তাব দেয় দুদক। দুদক মনে করে অন্তত তাদের এ সুপারিশ খুলে দেখলে বা আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দেশের মানুষ হয় তো কিছুটা হলেও বাড়তি সেবা পেত।
এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট দফতর দুদকের সুপারিশ আমলে নেয়নি বলেই আমরা মনে করি। কারণ সে মেতাবেক তারা কোনো কাজ করেনি। কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আমরা নীতিমালা করার কথা বলেছিলাম। কাজটি করা হলে অন্তত কিছুটা হলেও স্বস্তির জায়গা তৈরি হতো।
তিনি জানান, দুদক থেকে করা সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আবারও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেয়া হবে। আমরা অনুরোধ করব, দুদক টিম দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে যে সুপারিশ দিয়েছিল তা যেন বাস্তবায়নে নজর দেয় তারা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, মনে হচ্ছে দুদকের সুপারিশ স্বাস্থ্য বিভাগ বাস্তবায়ন করেনি। আর মন্ত্রণালয় এটা না করলে তা অনিয়ম ও দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেয়ার শামিল।
আমি মনে করি, স্বাস্থ্য বিভাগকে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে এটি দুদকের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ ছিল। এগুলো প্রতিরোধমূলক হলেও যৌক্তিকভাবেই সংশ্লিষ্টদের নজরে এনেছে। তবে এর ফলোআপও করা দরকার ছিল।
সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা। যেহেতু এ সুপারিশগুলো ছিল প্রতিরোধমূলক। কিন্তু প্রতিকার করার জন্য যে তথ্য ও অভিযোগ দুদকের হাতে আছে দুদক সে ব্যাপারে কতটুকু করতে পারছে, সে প্রশ্নও রয়েছে। দুদক এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কি নিয়েছে জনগণকে জানানো উচিত।
স্বাস্থ্যের একজন মহাপরিচালকের বিদায় বা নতুন মহাপরিচালক নিয়োগের মধ্য দিয়ে দুর্নীতি কমবে কিনা- এমন প্রশ্নে ইফতেখারুজ্জমান বলেন, মহাপরিচালক এককভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করেন না। নতুন মহাপরিচালকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ যেমন আছে। তেমনি সুযোগও আছে দুর্নীতিমুক্ত অধিদফতর গড়ে তোলার।
পূর্বসূরিদের মতো দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিয়ে কাজ করতে পারা হল তার চ্যালেঞ্জ। আর সুযোগ হাতছাড়া হবে যদি তিনি কাজ করতে না পারেন। দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারেন। এটা সরকার ও দেশবাসীর জন্য সুখকর হবে না।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরে স্বচ্ছতার কাজটি এখন থেকে নতুন ভাবে শুরু হতে পারে। নতুন মহাপরিচালক দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান করতে পারেন, আপনারা এসে দেখুন। তদন্ত করুন। আমি সহযোহিতা করব। এক্ষেত্রে মহাপরিচালকের ওপর বাধা আসতে পারে।
মন্ত্রণালয় তার ওপর নাখোশ হতে পারে। প্রভাবশালী মহল থেকে প্রভাব খাটানো হতে পারে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যদি তাকে সাহস দেয়া হয়। দুর্নীতিমুক্ত অধিদফতর গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয়, তা হবে দেশের জন্য বিরল দৃষ্টান্তের একটি কাজ।