অভিজাতপাড়ার বিপণিবিতান হিসেবে পরিচিত গুলশান ১ নম্বরের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেট। দোতলা এ বিপণিবিতানের নিচতলায় সিঁড়ির পাশে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের জন্য নির্ধারিত স্থান। কিন্তু সেখানে নেই কোনো অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম। দোতলায়ও একই দৃশ্য। আগুন নেভানোর সরঞ্জাম না থাকলেও বিপণিবিতানটির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুম ঘিরে রয়েছে ক্রেতাদের ভিড়।
সরজমিনে এ বিপণিবিতানে এমন চিত্রই চোখে পড়ে। অথচ এ বিপণিবিতানে ২০১৭ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান চিহ্নিত করে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মাঠে নেমেছিল ফায়ার সার্ভিস।
সংস্থাটির তথ্য বলছে, শুধু ডিএনসিসি মার্কেটই নয়, ঢাকার ১ হাজার ৫৯৫টি বিপণিবিতানের মধ্যে ১ হাজার ৫৭১টি বিপণিবিতানেই নেই অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা। বৈদ্যুতিক তার নষ্ট হয়ে অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে পুরনো বিপণিবিতানগুলো।
বিপণিবিতান ও বাণিজ্যিক ভবনের অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালিত জরিপে প্রতিবারই গুলশান ১ নম্বরের ডিএনসিসি মার্কেটের অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা না থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য বিপণিবিতানটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের সুপারিশ করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল দোকানিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় এক্সটিংগুইশারগুলো কয়েকদিন আগে খুলে নেয়া হয়েছে। এরপর এখনো সেটা স্থাপন করা হয়নি। অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম না থাকার কারণ সম্পর্কে ডিএনসিসি মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আক্তারুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শ অনুযায়ী পুরো বিপণিবিতানের অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। স্মোক ডিটেক্টর স্থাপন করা হয়েছে। তবে কয়েক দিন আগে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সেগুলো পুনরায় রিফিল করতে পাঠানো হয়েছে। এগুলো চলে আসবে কয়েকদিনের মধ্যেই।
’ এ সময়ের মধ্যে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা কীভাবে মোকাবেলা করবেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পানি আছে। আরো অনেক কিছু আছে। সমস্যা হবে না।’
গুলশান ১ নম্বরে বিপণিবিতানের অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম না থাকার বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘মার্কেটগুলোয় সমিতি রয়েছে। তারা সেখানে সবকিছুর দেখভাল করে। অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতার বিষয়ে এরই মধ্যে তাদের বলা হয়েছে। পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিসকেও আমরা চিঠি দিয়ে ঝুঁকি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি। এর পরেও যদি ব্যবস্থা না নেয় তাহলে প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট করা হবে।’
ডিএনসিসির এ বিপণিবিতানেই ২০১৭ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই অগ্নিকাণ্ডে ৩৮৯টি দোকান পুড়ে যায়, ভবন ধসে পড়ে।
সে সময় অন্য বিপণিবিতানগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এলে প্রথমবারের মতো ঢাকার সব বিপণিবিতানে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা যাচাইয়ে মাঠে নামে ফায়ার সার্ভিস। ওই সময় বিপণিবিতানগুলোর মেঝের আয়তন, অবস্থানকারী জনসংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফট, স্মোক হিট ডিটেক্টর, মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা চিহ্নিত করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ঢাকার ১ হাজার ৫৯৫টি বিপণিবিতান পরিদর্শন শেষে ৬৭৪টি বিপণিবিতানকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৮৯৭টি বিপণিবিতানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাকি ২৪টিকে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতাপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এরপর আর শুধু বিপণিবিতানগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে আলাদাভাবে জরিপ করেনি সংস্থাটি।
তবে ২০২০ সালে ঢাকার বহুতল, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শ্রেণীর ১ হাজার ৯১৮টি ভবন পরিদর্শন করে ১৫৭টি ভবনকে অতিঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭৫১টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালে বহুতল শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শ্রেণীর ৮৫৫টি ভবন পরিদর্শন করে ১০৪টি অতিঝুঁকিপূর্ণ ও ৪২০টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সর্বশেষ ২০২২ সালে বহুতল শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শ্রেণীর ১ হাজার ১৬২টি ভবন পরিদর্শন শেষে ১৩৬টিকে অতিঝুঁকিপূর্ণ ও ৪৯৯টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
অগ্নিনিরাপত্তায় এমন দুর্বলতা শুধু ডিএনসিসি মার্কেটেই নয়, রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন ঢাকা নিউমার্কেটেও।
রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় এ বিপণিবিতান পাঁচটি অংশে বিভক্ত। এর প্রতিটি অংশেই প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের সমাগম হয়। দোকানের সংখ্যা ১ হাজার ২০০। পুরো মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বলতে সব মিলিয়ে ১২টি এক্সটিংগুইশার রয়েছে। মার্কেটের সিঁড়িতে গাদাগাদি করে বসানো হয়েছে দোকান।
অগ্নিনিরাপত্তার দুর্বলতা বেসরকারি মালিকানাধীন বিপণিবিতানগুলোতেও দেখা গেছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শন তালিকায় গুলশান ১ নম্বরের নাভানা টাওয়ারকেও অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। বহুতল এ ভবনে নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত বিপণিবিতান রয়েছে। ওপরের তলাগুলোয় রয়েছে অফিস।
ভবনটির সিঁড়ির পাশে নির্ধারিত স্থানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখা যায়। পাশে সারি সারি বালতিতে বালি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। তবে সেখানে কর্তব্যরতদের কেউই এ এক্সটিংগুইশার ব্যবহার সম্পর্কে জানেন না। এ রকমই ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি বিপণিবিতান আজিজ সুপার মার্কেট। শাহবাগের এ মার্কেটে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, বই, জামাকাপড়সহ নানা পণ্যের দোকান রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতানের তালিকায় থাকা এ মার্কেটেও কোনো অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম দেখা যায়নি।
বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ঢাকার বিপণিবিতানগুলোর অগ্নিসক্ষমতা যাচাইয়ে মাঠে নেমেছে ফায়ার সার্ভিস। সেই ধারাবাহিকতায় এরই মধ্যে গাউছিয়া ও রাজধানী সুপার মার্কেট পরিদর্শন করেছেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
তারা জানান, ভবনের উচ্চতা, দোকান ও ক্রেতা-বিক্রেতা অনুপাতে কতগুলো অগ্নিনির্বাপক প্রয়োজন, সে সম্পর্কে অধিকাংশ মার্কেটসংশ্লিষ্টদের ধারণা নেই। এ অগ্নিনির্বাপকগুলো আবার দোকানের সবাই ব্যবহারও করতে পারেন না। অবকাঠামোটি কতটা নিরাপদ, সে সম্পর্কেও তারা খুব ভালো জানেন না। এছাড়া অতিরিক্ত লোকসমাগম হয় যেসব জায়গায়, সেসব জায়গায় স্মোক বা হিট ডিটেক্টর লাগানোর যে শর্ত আছে তাও মানা হয় না।
স্মোক হিট ডিটেক্টরের কাজ হলো একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধোঁয়া তৈরি হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সতর্কসংকেত বাজানো ও পানি ছিটানো। পুরনো বিপণিবিতানগুলো যেসব ভবনে, তার বড় অংশেরই বৈদ্যুতিক তার নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলোয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। বেশির ভাগ নতুন ভবনে ‘নিরাপত্তা’র বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। ফলে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। রাজধানী সুপারমার্কেট গতকাল পরিদর্শন শেষে এটিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, ‘বিপণিবিতানটির বৈদ্যুতিক লাইনে অপরিকল্পিত সংযোগ রয়েছে।
এ ধরনের অপরিকল্পিত সংযোগ মার্কেটের অগ্নিঝুঁকি আরো বাড়িয়েছে। কিছু ব্যবস্থা তারা নিয়েছে। এরই মধ্যে দুই লাখ লিটার পানি মজুদের ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এগুলো যথেষ্ট নয়। এখানে অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় আরো সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।’
ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের মুখপাত্র মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঢাকার ১ হাজার ৫৭১টি ঝুঁকিপূর্ণ বিপণিবিতান চিহ্নিত করে সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছিল।
কিছু বিপণিবিতান সুপারিশ বাস্তবায়ন করেছে। ফায়ার সার্ভিসের যেহেতু মামলা করার এখতিয়ার নেই, সেহেতু অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সুপারিশের বেশি কিছু করারও থাকে না। তার পরেও এ বছর পরিদর্শন শুরু হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে পদক্ষেপ নেবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হবে।’