The news is by your side.

জীবনের গল্প

0 306

 

 

নির্মলেন্দু গুণ

পরের দিন নাশতা করেই আমি আর মামুন ( নাট্যজন মামুনূর রশীদ) বকশীবাজারে যাই।

আমাদের দেখে পাবলিক হেলথ-গোডাউনের দারোয়ান এগিয়ে আসে। মামুনকে বলে, –“স্যার,

এই সায়েবের লেখা রাস্তায় দিলে মাইনসে আমারে মারবো। কিছুই তো পড়া যায় না। স্যার, উনি তো এই কামের লোক না, উনারে এই কাম দিলো কে?”

ততক্ষণে মামুন আমার গত তিনদিনের কাজের ওপর চোখ বুলিয়ে সেরেছে। মামুনের মুখ গম্ভীর। তাঁর মুখ থেকে হাসি উধাও।

“উনারে এই কাম কে দিলো”– এই জটিল প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই মামুন আমাকে বলে–“যত দ্রুত সম্ভব একজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট খুঁজে বের করেন। আমার চাকরি চলে যাবে।

তাড়াতাড়ি করেন।

আমি অফিসে যাই।

আপনি আর্টিস্টের খোঁজে যান। বোর্ডের এই লেখাগুলো সব মুছে ফেলতে হবে, তারপর নতুন করে লেখাতে হবে।

কিছু গচ্চা দিয়ে হলেও কাজটা দ্রুত শেষ করেন। টাকার জন্য ভাববেন না।”

হায় কপাল, টাকার জন্যই এতো, আর মামুন বলছে কি-না টাকার জন্য ভাববেন না?

আমি আমার কৃতকর্মের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভাগ্যকেই দোষারূপ করি।

জীবনের গল্প–২

খুবই আশ্চর্য বটে যে, বিলম্বে হলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানবান্ধব আমার ঐ কবিতাটির ( বিক্রির জন্য নয়) কথা আমার চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনের দিনই স্মরণে আসে। আমি আমার প্রদর্শনীর উদ্ধোধনী অনুষ্ঠান [ ১০ জুলাই, ২০১০] কী বলবো– এ নিয়ে আমি যখন ভাবনাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো বঙ্গকুললক্ষ্মী মোরে কহিলা স্বপনে–

“হে বৎস, ২৫ বছর আগে মৈমনসিংহের ধোপাখলায় বসে লিখেছিলি যে ছোট্ট পদ্যখানি–রে পামর, তাহা তুই ভুলিলি কেমনে?”

তিনি গায়েবী ভাষায় আমাকে এ-ও বলিলেন, “নিরঞ্জনের পৃথিবী” নামক কাব্যগ্রন্থে তুই পাবি সে কবিতাখানি।”

ঠিক তাই। আমি কবিতাটি পেলাম। আমার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পড়ার মতো এরকম যুতসই কবিতা আর হয় না।

কথা সেটি নয়, প্রশ্ন হলো ঈশ্বর কি আমার কবিতা পড়েন। তিনিও কি আমার কবিতার ভক্ত?

কে জানে?

দুধা চোরার গল্প

চোর হিসাবে সমাজে একবার পরিচিতি লাভ করলে, পরে ডাকাতি কইরাও চোর-পরিচয় বদলানি যায় না।

একদিন আমাকে একা পেয়ে এরকম আক্ষেপ করে কথাগুলি বলোছিলো আমাদের এলাকার জনপ্রিয়– দুধা চোর।

দুধা আমার সমবয়সী, বন্ধু।

সে দুঃখ করে আমাকে বলেছিলো, জানো কবি, (সে আমাকে কবি বলে ডাকতো) আমি কিন্তু চুরি করা ছাইড়া দিছি।

তাই? এইডা তো খুবই ভালা কথা। তো এখন কী করতাছো?

চারদিক দিক পানে তাকিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে চুপিস্বরে দুধা বললো–

“আমি অখন ডাকাতি করি।”

আমি ভয় পেয়ে গোলাম।

দুধা বলে কী?

আমি যে ভয় পেয়ে গেছি, দুধা তা বুঝলো। হাসলো।

বললো, ভয় পাইলা?

আমি মিথ্যে করে বললাম, না। ভয় পাবো কেন?

দুধা বললো, ডাকাইতরে তো ভয় পাওয়াই উচিত।

আমি মানলাম তার যুক্তি।

সে ঠিকই বলেছে।

মানুষ চোরকে করুণা করে ডাকাতকে ভয় পায়।

আমি বললাম, ভালাই করছো। গুড ডিসিশন।

আমার ঠোঁটের সিগারেটে দামী লাইটারে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে দুধা বললো– “ডাকাতি করলে কী অইবো রে ভাই, মাইনসে তো অহনও আমারে “ডাকাত” হিসাবে স্বীকার করে না।

কী বলে জানো?

আমি বললাম, না জানি না।

কী বলে?

একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুধা বলে- অহন মাইনসে বলাবলি করে, কয় “দুধা চোরে” “ডাকাতি” করছে।

আমার খুব হাসি পেলেও আমি হাসলাম না, কারণ দুধার কথাটার মধ্যে একটা বড় ধরনের দুঃখ লুকানো ছিলো।

আমি ভাবলাম–কবিখ্যাতি লাভের পর আমার অবস্থা তো হয়েছে ঐ দুধা চোরের মতোই। এখন আমি যত ডাকাতিয়া গদ্যই লিখি না কেন,–পাঠক আমাকে কবিই বলবে। বলে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় দুুধা চোরার গল্পটা শুনলে হাসতে-হাসতে মারা যেতেন।

স্মরণীয় যে, রবীন্দ্রনাথোর রচনাবলির ২৫খন্ডের মধ্যে মাত্র ৫খন্ড হচ্ছে কাব্য– বাকি ২০খন্ডই গদ্যরচনা।

তিনি শুধু কবি নন, বিশ্বকবি তিনি।

পুনর্লিখন

২৬ এপ্রিল ২০২২।

পূর্বলিখন

চোর হিসাবে সমাজে একবার পরিচিতি লাভ করলে, পরে ডাকাতি করেও চোর-পরিচিতি ঘোচানো যায় না।

একদিন আমাকে একা পেয়ে এরকম আক্ষেপ করেছিলো আমাদের এলাকার– দুধা চোর।

দুধা আমার সমবয়সী, বন্ধু।

সে দুঃখ করে আমাকে বলেছিলো, জানো কবি, আমি কিন্তু চুরি করা ছাইড়া দিছি। এখন আমি ডাকাতি করি।

কিন্তু ডাকাতি করলে কী অইবো, মাইনসে অহনও আমারে “ডাকাত” হিসাবে স্বীকার করে নাই- কী বলে জানো?

আমি বললাম, না জানি না।

কী বলে?

একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দুধা বলে- মাইনসে কয় “দুধা চোরে” “ডাকাতি” করছে।

কবিখ্যাতি লাভের পর আমার অবস্থা হয়েছে ঐ দুধা চোরের মতো। আমি যত গদ্যই লিখি না কেন, লোকে আমাকে কবিই বলে। বলবে।

রবীন্দ্রনাথ দুুধা চোরার এই গল্পটা শুনলে হাসতে-হাসতে মারা যেতেন। স্মরণীয় যে রবীন্দ্রনাথের রচনাবলির মাত্র পাঁচখন্ড হলো কাব্য, বিশ খন্ডই গদ্য।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.