জাতীয় পার্টির (জাপা) বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আংশিক সত্য বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি সম্পর্কে অনেকে অনেক কথা বলেন, কথাগুলো আংশিক সত্য। সব সঠিক না হলেও অনেক কথার মধ্যে অনেক সঠিক ব্যাপার থাকে।’
আজ দুপুরে বনানী কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। গত সংসদে জাতীয় পার্টির ভূমিকা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বিরোধী দলের দায়িত্ব গ্রহণের ব্যাপারে দলটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ আংশিক সত্য বলে মন্তব্য করেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
তিনি বলেন, ‘অনেকে যেমন বলছেন, আমাদের দল ভাগ হয়ে যাবে। দল ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা এই মুহূর্তে আমি দেখি না। আরও একটা দল গঠন করতে পারেন, এরশাদ সাহেবের নাম দিয়ে, তার আদর্শ নিয়ে আরও ১০টা দল গঠন করতে পারেন তারা।
জি এম কাদের বলেন, নতুনভাবে দল গঠন করার প্রক্রিয়া আছে। এরপর সেই দলটি নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া আছে। সেটা করে যে কোনো লোক করতে পারেন। আমরা যে কাঠামোতে এগিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকে ভেঙে নিয়ে নতুন করে দল গঠন করার এখনও সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি, সম্ভাবনা আমার চোখে পড়ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘একটা কথা আমি বলতে চাই, আমাদের সবার স্মরণ রাখা উচিত, আমাদের দলের ব্যাপার মানুষের পারসেপশনটা কিন্তু খুব একটা ভালো নয়।’
জি এম কাদের আরও বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে ফাইট করে গেছি, সব ঠিক আছে। উনারা শুধু নৌকাটা তুলে নিয়েছিলেন। কেননা উনারা বলেছিলেন, দলীয়করণের মাধ্যমে যে নির্বাচন কুলষিত হয় বা দলীয়করণের কারণে বিভিন্নভাবে যে নিয়ম-কানুনগুলোকে ভঙ্গ করা হয়, সেটার জন্য উনাদের প্রতীক বা প্রার্থী না থাকলে সহজ হবে। কিন্তু উনারা প্রার্থী দিয়েছিলেন, বেশিরভাগ জায়গায় এবং প্রার্থীর সঙ্গে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে সমানভাবে। যাইহোক, এটার মধ্যে পরনির্ভরশীলতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আরেকটা বলেছেন, আমাদের গবেষক ও সাহিত্যিক মহিউদ্দিন আহমেদ। তার একটা সাক্ষাৎকারে আমাদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আমরা পরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর ফলে এ রকম দল থাকার কী দরকার! আরেক দল যদি তাকে নিয়ন্ত্রণই করে, তাহলে সে দলের অর্থ কী? এটা আংশিক সঠিক। আমরা নিয়ন্ত্রিত হয়েছি, এটা পারশিয়ালি কারেক্ট; আমরা চেষ্টা করছি বেরিয়ে আসার জন্য।’
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি বলছি না যে, দল ভাঙবে কিন্তু দলের মধ্যে সংশোধন হওয়া দরকার আছে। কঠোর সংশোধন যদি আমরা করতে না পারি, সামনের দিকে দল ভাঙবে না—দল টিকবে না। দলের অস্তিত্বের মূল্য জনগণের কাছে থাকবে না। দলকে মানুষ ভালোবাসবে না, দলের প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না, মানুষ মনে করবে না দল তাদের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। হয়তো মনে করবে কিছু নেতা-নেত্রীদের ব্যক্তিগত স্বার্থে দলটি ব্যবহৃত হচ্ছে। তাহলে জনগণের দল হবে না, জনগণের দল ছাড়া দল টিকবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাস্তবতা হলো আমাদের এই নির্বাচন নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ একটা বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিয়েছে যে, আমরা আওয়ামী লীগের ২৬টি সিট ছেড়ে দিলাম জাতীয় পার্টির ফেভারে। তারা একটা সিটও জাতীয় পার্টির ফেভারে ছাড়েনি। সব জায়গায় তাদের লোক দিয়ে রেখেছে, ফাইট করেছে এবং আমাদের লোক অনেক জায়গায় সেখানে যে কোনোভাবেই হোক পরাজিত করা হয়েছে বা করেছে। কিন্তু বিভ্রান্ত করা হয়েছে, আমাদের প্রার্থীও বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকে এটাকে মহাজোট বলেছেন, অনেকে সিট ভাগাভাগি বলেছেন। আমি প্রথম দিন থেকে বলেছি, এটা মহাজোট হয়নি, এটা সিট ভাগাভাগি হয়নি। এটা আওয়ামী লীগ ইচ্ছা করে করেছে অথবা ভুলক্রমে করেছে। আমাদের চরম ক্ষতি করেছে এটার কারণে।
দলের ভাঙন নিয়ে উদ্বিগ্ন নন জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ‘সংসদে সংখ্যা কোনো ব্যাপার না। ছয়জন লোক সংসদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল গত সংসদে। দুই-তিনজন লোক থাকলেই কাঁপিয়ে দেওয়া যায়। যদি সত্যি কথা বলা যায় এবং বলার সুযোগ পাওয়া যায়। অনেক কড়া কড়া কথা আমরা বলেছি। কিন্তু আমাদের দল থেকে আরেকজন গিয়ে ঠিক উল্টো কথা বলেছেন একই পার্লামেন্টে। যদি পাঁচ-সাতজন লোকও আমাদের বিপক্ষে বলতে থাকেন এবং আমরা যদি তাদের বের না করে দেই পার্টি থেকে, তাহলে সেই পার্টি কোনো গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে থাকে না।
জনগণ সত্যিকার অর্থে বিকল্প খুঁজছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে একটা শক্তিকে গ্রহণ করার জন্য জনগণ বসে আছে। জনগণ জানে, আওয়ামী লীগ চলে গেলে, বিএনপি এলে শুধু মানুষের চেহারার পরিবর্তন হবে। যে অনিয়ম, যে দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের অত্যচার-অনাচার, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি সব কিছু একই প্রক্রিয়ায়, একইভাবে চলতে থাকবে। তথাপি মানুষ পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন চাচ্ছে এই মুহূর্তে। সত্যিকারের যে পরিবর্তন সেটার জন্য যে দল, সেটা জাতীয় পার্টি দিতে পারবে যদি আমরা আপসকামীতা বাদ দিয়ে দেই।’
গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে জি এম কাদের বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের আগের কমিটি যখন ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তখন তারা প্রেসক্লাবে মিটিং করে। ৩০-৪০ জন লোক নিয়ে আসে, যাদের বেশির ভাগই জাতীয় পার্টির লোক ছিল না—আমরা যতটুকু ভেরিফাই করেছি। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, কয়েকজন বহিষ্কৃত নেতা ছিলেন। হঠাৎ করে ঘোষণা দিলেন ৬৭১ জন গণপদত্যাগ করেছে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন কমিটি থেকে। এটা মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এ রকম প্রচারণা আমি খুব কম দেখেছি।’
নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই নিউজগুলো আমি হলে ভেরিফাই করতাম; ৬৭১ জনের তালিকাটা দেন। অথবা এটা ভেরিফাই করা হয়নি, ঘোষণা করা হয়েছে। এরপরে কয়েকজন নেতাকর্মী শৌচাগার ব্যবহার করতে চেয়েছিল, তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। সেটাকে প্রচারিত হলো—জাতীয় পার্টির অফিস দখল হয়ে গেছে। দখল কতক্ষণ ছিল, কে করল, কেন করল। আমার মনে হয়েছে, এটা আরেকটু ভেরিফাই করা উচিত ছিল।’