জান্নাতুল ফেরদৌস
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে তীব্র তাপদাহে বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়। সময় চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়, যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মে মাসের ৩০ তারিখের পর থেকে নতুন করে শুরু হয় আরেকটি তাপপ্রবাহ।
বাংলাদেশের তীব্র তাপদাহের কারণ- বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বনায়নের পরিমাণ কমে যাওয়া, কলকারখানা বৃদ্ধি, গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যবহার বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও অতিরিক্ত জনসংখ্যা।
গবেষকরা তাপদাহের পেছনে গ্রিনহাউস গ্যাসের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে প্রধান কারণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপ বৃদ্ধির মাত্রা ১ দশমিক ৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ১৮৫০-১৯০০-এর চেয়ে বিগত এক দশকে (২০১১-২০২০) ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১ দশমিক শূন্য ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। তাপমাত্রা কমানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই শতকেই পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশের ওপর এর প্রভাব পড়বে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অবদান শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থান সপ্তমে রয়েছে। এই শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে পানির উচ্চতা প্রায় ১ মিটার বাড়বে। এতে বাংলাদেশের মোট ভূমির ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সুন্দরবনের প্রায় ৭০ শতাংশ তলিয়ে যাবে। ২০৫০ সালের মধ্যে ১৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে এবং প্রতি ৭ জনে ১ জন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। ২১০০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা ৫০ মিলিয়নে দাঁড়াবে বলে জানিয়েছে সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিন।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা। তীব্র তাপদাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, বজ্রপাত, নদীভাঙন, ভূমিকম্প ইত্যাদি আগের তুলনায় আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যাঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে প্রথম অবস্থানে।
২০০০-২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ১৮৫টি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে এবং ৩ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ইউএস ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবছর জলবায়ুজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বাংলাদেশের শূন্য দশমিক ৮-১ দশমিক ১ শতাংশ জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইপিসিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০১৪-২১ সালের মধ্যে প্রায় ৮,৫০,০০০ পরিবার এবং ২,৫০,০০০ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডব্লিউএমও অনুযায়ী বিগত ৫০ বছরে জলবায়ুজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ২০০৯, ডেল্টা প্ল্যান ২১০০, কোস্টাল গ্রিন বেল্ট প্রকল্প, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা ২০০৯, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জাতীয় পরিকল্পনা ২০২১-২৫, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি, মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা দশক ২০৩০সহ অসংখ্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারবে।