কক্সবাজার অফিস
বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে ১২টি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে জান্তা সরকারের সেনা সদস্যরা। আর এতে কেঁপে উঠলো শূন্যরেখায় আশ্রিত সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গাসহ ঘুমধুমের ১২ পাড়া। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন- তুমরু বাজার ব্যবসায়ী বদি আলম গ্রাম পুলিশ আবদু জাব্বার, রোহিঙ্গা আবদুচ্ছালাম, দক্ষিণ চাকঢালার ফরিদ আলম ও জাফর আলী।
রোববার সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে এ মর্টারশেলের প্রকট আওয়াজে ঘুমভাঙ্গে ১২ পাড়া মানুষের। শনিবার রাত ৮টায় মিয়ানমারের একটি যুদ্ধ বিমান তুমব্রু শূন্যরেখায় ঘেঁষে মিয়ানমার আকাশে উড়তে দেখেছে তুমব্রুসহ সীমান্তের বাসিন্দারা। রোববার সারাদিন মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে সীমান্ত জুড়ে।
স্থানীয়রা জানান, সীমান্তের ১২ গ্রামের মানুষ তটস্থ। গ্রামগুলো হলো- তুমব্রু, কোনার পাড়া, বাইশফাঁড়ি, তুমব্রু হেডম্যানপাড়া, ভাজাবুনিয়া, মধ্যমপাড়া, উত্তরপাড়া,বাজার পাড়া, গর্জনবুনিয়া সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ চাকঢালা, সাপমারা ঝিরি ও জামছড়ি।
বিজিবির অপারেশন্স বিষয়ক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনকে বিজিবির পক্ষ থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওই অংশে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিক যারা আছেন, নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে, তাদেরকে অস্থায়ীভাবে নিরাপদ কোন জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তমব্রু এলাকায় বিজিবির পাঁচটি আউট পোস্ট রয়েছে। মিয়ানমারে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সেখানে মোতায়েন বিজিবির সদস্য সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে এবং গোয়েন্দা ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মিয়ানমারের কোন নাগরিক যাতে বাংলাদেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে শক্ত অবস্থান নেয়া হয়েছে।
তুমব্রু শূন্যরেখায় আশ্রিত একাধিক রোহিঙ্গা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জান্তা সরকারের আর্মি ও জান্তা বিদ্রোহী আরকান আর্মির মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে মিয়ানমার সীমান্তে। তাদের গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ছে বার বার।
শুক্রবারের গোলা আঘাতে হতাহতের রাতটা ছিলো তাদের কাছে ভয়াবহ একটি ঘটনা। আর সে কারণে তুমব্রু শূন্যরেখায় আশ্রিত সাড়ে ৪ হাজার রোহিঙ্গা এখন এ ক্যাম্প ছেড়া অন্যত্র পালাচ্ছে ছোট ছোট দলে।
রোববার সকাল ১১টায় নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে সীমান্তে উদ্ভূত পরিস্থিতে জনপ্রতিনিধিদের করণীয় শীর্ষক এক জরুরি সভা ডাকেন নির্বাহী অফিসার সালমা ফেরদৌস। সালমা ফেরদৌস জানান, বিষয়গুলো সরকারের উপর মহল অবগত আছেন। তবে এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী হতে পারে আর এসবে প্রতীকার নিয়ে সবাইকে কাজ করার নির্দেশনা দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। বিশেষ করে সরকার শান্তি চায় আবার যে কোন পরিস্তিতি বিধি সম্মতভাবে মোকাবেলাতেও সজাগ আছে।
সীমান্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে ৩শ পরিবারকে সরিয়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে প্রশাসন। সীমান্তের কাঁটাতার বেড়া সংলগ্ন তুমব্রু, ঘুমধুম, হেডম্যান পাড়া, ফাত্রা ঝিড়ি, রেজু আমতলী এলাকায় বসবাসকারী এসব পরিবারের প্রায় দেড় হাজার লোককে নিরাপদ স্থানে নেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে পর্যালোচনা চলছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে বৈঠকের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে বৈঠকে জানানো হয় ঘুমধুম ইউনিয়নে কোন আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় পরিবারগুলোকে সরিয়ে নেয়ার বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া স্কুলগুলোতেও থাকার কোন পরিবেশ নেই। এ পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। এছাড়াও ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গির আজিজ ও সদর ইউনিয়ন পরিষদ নুরুল আবসার ইমন আরো বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার সরকারের সেনাসহ যৌথ বাহিনী ও তাদের বিদ্রোহী আরকান বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। বিশেষ করে ঘুমধুমের কোনার পাড়াসহ ৮ গ্রাম আর সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ চাকঢালাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দু’বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছে প্রকট আওয়াজে। যাতে তাদের ইউনিয়নের সকলে ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। বিশেষ করে এসএসসি পরীক্ষার্থীরা ভয়ে পড়া—লেখা পযর্ন্ত করতে পারছে না।
সীমানা ঘেঁষে এ গোলাগুলিতে সীমান্ত সড়কের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে ১৫ থেকে ২০ দিন । একই সাথে সীমান্তে বিভিন্ন বাগান ও ক্ষেত—খামারের কাজও বন্ধ থাকায় শতশত সীমান্তবাসী মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে বর্তমানে। শুক্রবার মিয়ানমারের মর্টারশেলের হামলায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১০ নম্বর সেটের ইকবাল উদ্দিন (২৮) নামের যুবক নিহত ও কাছাকাছি হেডম্যান পাড়ার ১০০ গজ পূর্বে ৩৫ পিলারের কাছে মিয়ানমার বাহিনীর পুঁতে রাখা স্থলমাইনে বাঙালি অন্যখাই তংচঙ্গার পা উড়ে যাওয়ার পর সীমান্ত জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত রয়েছে ২৮০ কিলোমিটার। তন্মধ্যে নাইক্ষ্যংছড়ির বিপরীতে স্থল সীমানা ৯১ কিলোমিটার। মিয়ানমার বাহিনী ও আরকান আর্মির যুদ্ধ চলছে ৩৮ কিলোমিটার ৩১ থেকে ৪০ আর ৪৪ ও ৪৫ পিলার এলাকার বিপরীতে। তবে যুদ্ধ না চললেও মিয়ানমার সীমানার বাকি পিলার এলাকা ঝুঁকিতে।