চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, কর্তৃপক্ষের উদ্যোগহীনতা ও প্রশিক্ষণের অভাবে ৪৭ শতাংশ হাসপাতালে রোগী বাছাইয়ের কাজটি হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় এমন ত্রুটি হাসপাতালে সংক্রমণের ঝুঁকি না কমার একটি কারণ।
রোগী বাছাই বা পৃথক করার কাজকে বলা হয় ট্রায়েজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগী ব্যবস্থাপনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এটি। উদ্দেশ্য, রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা। মহামারির এই সময়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে ট্রায়েজের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এখন এই পদ্ধতি দরকার সংক্রমণ কমানোর জন্য। কোভিড ও নন–কোভিড রোগী আলাদা করতে এই পদ্ধতি চালু করার নির্দেশনা থাকলেও অনেক হাসপাতালে তা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘হাসপাতালে কোভিড ও নন–কোভিড সব ধরনের রোগী চিকিৎসা নিতে আসবে। সব ধরনের রোগী একসঙ্গে থাকলে সংক্রমণ বাড়বে। তাই হাসপাতালে ঢোকার মুখেই রোগীদের পৃথক করতে হবে।’
দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে সরকারি–বেসরকারি সব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী কমেছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। আবার সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক ও নার্স সংক্রমিত হয়েছেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘ট্রায়েজ ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেন।’
এ পর্যন্ত হাসপাতালে কত সাধারণ মানুষ বা নন–কোভিড রোগী গিয়ে করোনা সংক্রমিত হয়েছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বলছে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ হাজার ৪১৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক ১ হাজার ৮৬৮ জন, নার্স ১ হাজার ৪৯১ জন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ২ হাজার ৬০ জন। বিএমএ বলেছে, এঁদের একটি অংশ সংক্রমিত হয়েছেন কোভিড রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে। একটি অংশ নিজেদের অজান্তে সেই সব সাধারণ রোগীকে সেবা দিয়েছেন, যাঁরা বাস্তবে কোভিড রোগী ছিলেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা নিতে বলেছে, সেগুলোর মধ্যে রোগী বাছাইয়ের কথাও আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ট্রায়েজ বা রোগী বাছাই পদ্ধতি প্রবর্তনের কথা বলেছিল। কিন্তু কাজটি দেশব্যাপী সঠিকভাবে হয়নি।
চীনের ঝেঝিয়াং ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনের চিকিৎসক ও গবেষকেরা চীনের করোনা রোগীর চিকিৎসার অভিজ্ঞতা থেকে ‘হ্যান্ড বুক অন কোভিড–১৯ প্রিভেনশন অ্যান্ড ট্রিটমেন্ট’ শিরোনামে একটি নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এর শুরুতেই বলা হয়েছে, হাসপাতালে তিনটি এলাকা থাকবে: করোনা সংক্রমিতদের এলাকা, সন্দেহভাজন করোনা এলাকা এবং করোনা সংক্রমিত নন এমন রোগীদের এলাকা। তিনটি এলাকাই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত থাকতে হবে, যেন সহজে সবার চোখে পড়ে। রোগী হাসপাতালে এলে প্রাথমিক পরীক্ষার পরই নির্দিষ্ট এলাকায় পাঠাতে হবে। পরীক্ষার সময় কম নিতে হবে। এই তিনটি এলাকার ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাতে বিস্তারিত বলা আছে। তবে চীনের মতো করে বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় বলে সরকারি কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা মন্তব্য করেছেন।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি গত এপ্রিলে রোগী পৃথক করার কাজটি কীভাবে হবে লিখিতভাবে তার বিস্তারিত দিয়েছিল অধিদপ্তরকে। তাতে হাসপাতালে ঢোকার মুখেই রোগী বাছাইয়ের কাজটি করতে বলা হয়। কমিটি কোভিড রোগীদের জন্য লাল এলাকা, নন–কোভিড রোগীদের জন্য সবুজ এলাকা এবং সন্দেহজনক রোগীদের জন্য হলুদ এলাকা চিহ্নিত করার কথা বলেছিল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান বলেন, জেলা–উপজেলাসহ সব পর্যায়ের হাসপাতালের চিকিৎসকদের এ ব্যাপারে ভার্চ্যুয়াল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি হাসপাতালে নির্দেশিকা পাঠানো হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, দেশের ৫৩ শতাংশ হাসপাতালে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নির্দেশিকা পৌঁছেছে। ৪৭ শতাংশ হাসপাতালে কোনো নির্দেশিকা যায়নি।
হাসপাতালে আসা সংক্রমিত ও অসংক্রমিত রোগীদের শুরুতে আলাদা করা জরুরি। অনেক হাসপাতালে কাজটি ঠিকমতো হচ্ছে না।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক উত্তম বড়ুয়া বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর রোগীদের তিন ভাগ করা হচ্ছে। কোভিডের উপসর্গ থাকলে রোগী পৃথক বহির্বিভাগে পাঠানো হচ্ছে। বহির্বিভাগে আবার পরীক্ষার পর হয় ভর্তি করানো হচ্ছে, না হয় বাড়িতে চিকিৎসা নিতে বলা হচ্ছে। নন–কোভিড রোগীদের পৃথক বহির্বিভাগে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে মূল্যায়নের পর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহভাজন রোগীদের নিয়ে কিছু জটিলতা আছে। তাঁদেরকে পৃথক ওয়ার্ডে রাখা হচ্ছে এবং দ্রুত রোগ শনাক্তের পরীক্ষার পর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এই হাসপাতালে ২৭ জুন থেকে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। সকাল দুজন, বিকেলে দুজন এবং রাতে একজন চিকিৎসক রোগী বাছাইয়ের কাজ করেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের বহির্বিভাগে আগে দৈনিক চার থেকে সাড়ে চার হাজার রোগী আসতেন, এখন আসছেন দেড় থেকে দুই শ।
এই হাসপাতালের পাশে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট এবং জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট। এই দুই বিশেষায়িত হাসপাতাল রোগী পৃথক করা নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। কিডনি ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেন, জটিল রোগীদের পরীক্ষা–নিরীক্ষায় সময় লাগে। তাঁদের সঙ্গে আসা আত্মীয়স্বজন হাসপাতাল ঘুরে বেড়ায়। বিভিন্ন রোগীর শয্যায় গিয়ে বসে। রোগীদের পৃথক করা সম্ভব হলেও স্বজনেরা সংক্রমণের ঝুঁকি হয়ে আছে।
খুলনা জেলার দক্ষিণের একটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একজন মেডিকেল কর্মকর্তা বলেছেন, বহির্বিভাগের টিকিট বিক্রেতারাই রোগীকে জ্বর, কাশি, গলাব্যথা আছে কি না জিজ্ঞেস করেন। ওই হাসপাতালে ট্রায়েজ বলে কিছু নেই। এ ব্যাপারে কোনো প্রশিক্ষণ হয়নি।
দেশের উপজেলা, জেলা ও সদর হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো কিংবা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোর অবকাঠামো এক রকম নয়। একটি অভিন্ন পদ্ধতিতে রোগী পৃথক করা কঠিন।
দেশের একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রয়োজন বিজ্ঞানটি বোঝা, আন্তরিকতা এবং বাস্তব বুদ্ধির প্রয়োগ। কোনো হাসপাতালে দুটি ভবন থাকলে দুটি দুই কাজে ব্যবহার করতে হবে। একটি ভবন থাকলে ঝুঁকি বিবেচনায় বিভিন্ন তলা ভাগ করে নিতে হবে। জায়গা না থাকলে হাসপাতালের সামনে তাঁবু টাঙিয়ে রোগী পৃথক করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারেন, সংক্রমণ প্রতিরোধে হাসপাতালে বিশেষ বাছাই ব্যবস্থা আছে, তাহলে তাঁরা হাসপাতালে যাবেন। ট্রায়েজ না করে কোনো রোগী ভর্তি করা উচিত নয়। কোনো কোনো হাসপাতাল এটা কীভাবে করছে, তা স্পষ্ট নয়।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘হাসপাতাল ব্যবস্থাপকদের অনেকেই ট্রায়েজের গুরুত্ব বুঝতে পারছেন না। এই ব্যবস্থাকে এড়িয়ে বা বাদ দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’