দেশে করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে তিন লাখ ৬ হাজার ৭৯৪ জন আর মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ১৭৪ জনের। গত বেশ কয়েকদিন ধরেই করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গত সাত দিনে গড়ে মারা গেছেন প্রায় ৪৫ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন– করোনার চরিত্রের পরিবর্তনের কোনও বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি, তবে এর গতি-প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। এছাড়া সম্প্রতি মৃত্যু বাড়ার পেছনে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাও দায়ী আছে বলে মনে করেন তারা।
স্বাস্থ্য মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, এর বড় একটি কারণ হচ্ছে রোগীরা দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। দেরিতে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন টেলিমেডিসিনের সাহায্যে মানুষকে বাসায় সার্ভিস দিচ্ছি। কিন্তু একটা রোগী যখন খারাপ হতে থাকে তখন তাকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য হাসপাতালে থাকা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘যদিও আমরা বলছি, শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য জটিলতা না থাকলে হাসপাতালে আসার দরকার নেই। কিন্তু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তাদের কোমরবিড ইলনেস যুক্ত (যেমন– ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসার অথবা এমন কোনও রোগ রয়েছে যার জন্য তাকে স্টেরয়েড খেতে হয়) রোগীরা যদি কোভিডে আক্রান্ত হন তারা যেন কখনও বাসায় না থাকেন।’
মার্চে করোনা শনাক্ত হয় ৫১ জন এবং মৃত্যু হয় ৫ জনের। এপ্রিলে ৭ হাজার ৬১৬ জন শনাক্ত হয় এবং মৃত্যু হয় ১৬৩ জনের। মেতে শনাক্ত হয় ৩৯ হাজার ৪৮৬ জন এবং মৃত্যু হয় ৪৮৩ জনের। জুনে শনাক্ত হয় ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের এবং মৃত্যু হয় এক হাজার ১৯৭ জনের। জুলাইতে শনাক্ত হয় ৯১ হাজার ৯১৮ জন এবং মৃত্যু হয় এক হাজার ২৬৪ জনের। আগস্টে এখন পর্যন্ত শনাক্ত ৬৯ হাজার ১৩৩ এবং মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৬৩ জনের।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় মার্চ মাসে কম সংখ্যাক শনাক্ত ও মৃত্যু দিয়ে করোনার সংক্রমণ শুরু হলেও ধীরে ধীরে বাড়ে এপ্রিলে এবং এক লাফে বেড়ে যায় মে মাসে। মে থেকে শুরু করে জুন, জুলাই ও আগস্টের এখন পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত আছে। তবে আগস্টের শেষে এসে সংক্রমণের হার কিছুটা নিম্নমুখী বলে ধারণা দেয় পরিসংখ্যান। তবে মৃত্যু বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য মতে, ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৮৫। আর সেদিন ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৩৫। এরপর ১৫ মে পর্যন্ত শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ৫০, ২০ মে তে শনাক্তের হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১১।
২৬ মে থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার প্রকাশ করা শুরু করে। এদিন ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আর হিসাব করে দেখা গেছে, এদিন পর্যন্ত মোট শনাক্তের হার ছিল ১৪ দশমিক ২২। ৩১ মে শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, ৩০ জুন শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ৩০ জুলাই ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। বিগত চার মাসের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শনাক্তের হার ২০-২৫ শতাংশের মধ্যেই আছে। শুধু গত ৩ আগস্ট শনাক্তের হার ছিল রেকর্ড সংখ্যাক ৩১ দশমিক ৯১ শতাংশ। দেশে ৮ মার্চ করোনা শনাক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ শনাক্তের হার। স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২৬ শতাংশ।
দেশে এখন পর্যন্ত করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ১২৬টি। পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে তিন লাখ ছয় হাজার ৭৯৪ জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চার হাজার ১৭৪ জন এবং সুস্থ হয়েছেন এক লাখ ৯৬ হাজার ৮৩৬ জন। অর্থাৎ করোনা সক্রিয় রোগী আছেন বর্তমানে এক লাখ পাঁচ হাজার ৭৮৪ জন।
গত ২ জুলাই দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায় ২৪ ঘণ্টায়। এদিন শনাক্তের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৯। এরপর ধীরে ধীরে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কমতে থাকে। ১৫ জুলাই শনাক্ত হয় তিন হাজার ৫৫৩ জন। এরপর এখন পর্যন্ত মাত্র তিন দিন তিন হাজারের উপরে শনাক্ত হয়েছে। বাকি দিনগুলোতে শনাক্ত তিন হাজারের নিচেই ছিল। আগস্টের শেষে এসে বিগত কয়েকদিন করোনা আক্রান্ত শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে এখন ১৬ শতাংশে অবস্থান করছে। তবে বিগত বেশ কয়েক দিন ধরেই করোনা আক্রান্ত হয়ে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গত সাত দিনে গড়ে মারা গেছেন প্রায় ৪৫ জন।
করোনাতে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চার হাজার ১৭৪ জন। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মানুষের বয়স ৬০ বছরের উপরে। শুক্রবার (২৮ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন; যা শতকরা শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ। ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১০০ জন; যা দুই দশমিক ৪০ শতাংশ। ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৫৫৯ জন; যা ১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে এক হাজার ১৫১ জন; যা ২৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ৬০ বছরের বেশি বয়সী মারা গেছেন দুই হাজার ৬৪ জন; যা ৪৯ দশমিক ২১ শতাংশ।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘ভাইরাসের চরিত্র বদল হয়েছে এখন পর্যন্ত কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই রকমই আছে। তবে গতি প্রকৃতি বদলেছে। সংক্রমণ কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার ২০-এর নিচে। শনাক্ত আগের চেয়ে কম হলেও ১৭-২০ এই সীমার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। দু সপ্তাহ আগেও মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪০-এর নিচে, এখন ৪০-এর উপরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা শনাক্ত হওয়ার তিন সপ্তাহ পর যারা ঝুঁকিপূর্ণ রোগী তাদের মধ্যে মৃত্যুর প্রবণতা দেখা যায়। কাজেই এখন যে সংক্রমণ সেটার প্রভাব পাওয়া যাবে আরও দুই সপ্তাহ পরে। এখনকার মৃত্যু হচ্ছে দুই সপ্তাহ আগের সংক্রমণের ফল।’
করোনা বিষয়ক সরকারের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘সংক্রমণ যেভাবেই ছিল সেভাবেই চলছে। এটাকে কমানোর চেষ্টা কেউ করছি না। আমরা এপ্রিল, মে, জুনের দিকে যেসব চেষ্টা শুরু করেছিলাম, সবই স্থিমিত হয়ে গেছে। এটি আমাদের জন্য, দেশের জন্য খুবই খারাপ। মৃত্যু কমানোর জন্য আমাদের দরকার কোভিড ম্যানেজমেন্টের মধ্যে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করা। অর্থাৎ আমরা হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে কী করছি। এই চিকিৎসায় তো কোনও ওষুধ নেই। শুধু ঠেকানোর একমাত্র পথ হচ্ছে ভ্যাক্সিন।’
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন রকম। কোনও কোন হাসপাতালে বেশি, আবার কোথাও কোথাও কম। এরকম কেন? আমরা যদি সেসব হাসপাতালের তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারতাম, তাহলে নিশ্চয়ই কিছু বের করতে পারতাম। আমরা এখন খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমরা সবাই একরকমের হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমরা চেষ্টা বন্ধ করেছি, আমরা মনে করছি, করোনা নিয়ে যা করার করে ফেলেছি। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।’