প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আবার কাবু হয়ে পড়েছে পুরো ইউরোপ। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। কোটি কোটি মানুষের ওপর আবারও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। এর ফলে ফ্রান্স, ইতালি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ আবারও প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বেলজিয়াম আবার করোনা ‘সুনামি’র মুখে পড়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক ব্যান্ডেনব্রাউক সতর্ক করে দিয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপে এক সপ্তাহে করোনা রোগীর সংখ্যা ৪৪ শতাংশ বেড়ে গেছে। এটা ‘অত্যন্ত দুশ্চিন্তার’ বিষয় মন্তব্য করে সংস্থাটি বলছে, কয়েক মাসের মধ্যে ইউরোপে গত এপ্রিলের পিকের (চূড়া) তুলনায় মৃত্যু পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এরই মধ্যে এই মহাদেশে করোনায় মৃত্যু আড়াই লাখ ছাড়িয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সংক্রমণ লাফিয়ে বাড়লেও এবার মৃত্যু আগের তুলনায় খুবই কম।
গত এপ্রিল ও মে মাসে করোনার প্রথম ধাক্কায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অনেকটা নিরাপদ থাকলেও এবার তারাও আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত ইউরোপে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের কারণে বিশ্ব আবার রেকর্ড সংক্রমণ দেখেছে। এক দিনে চার লাখের বেশি লোক আক্রান্ত হয়েছেন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে শনিবার থেকেই রাত্রিকালীন কারফিউ জারি হয়েছে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসসহ ৯টি শহরে। এ অবস্থা চলবে অন্তত এক মাস। দেশটিতে এক দিনে ৩২ সহস্রাধিক লোক আক্রান্ত হয়েছেন। ইংল্যান্ডে পারিবারিক জমায়েতের ওপরে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দেশটির অর্ধেক জনসংখ্যার ওপর এ কড়াকড়ি বহাল থাকবে। যুক্তরাজ্যে রোববার ১২ হাজার ৮৭২ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। গত ৪ অক্টোবর যুক্তরাজ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২২ হাজার ৯৬১ জন। প্রাণহানির দিক থেকে ইউরোপের মধ্যে শীর্ষে থাকা দেশটিতে এ পর্যন্ত করোনায় প্রায় ৪৩ হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় একগুচ্ছ নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইতালি।
স্থানীয় মেয়রদের রাত ৯টা থেকে জনসমাগমস্থল বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে সরকার। রেস্তোরাঁ খোলা রাখার সময় এবং দলগতভাবে জমায়েতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। রোববার ইতালিতে দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির নতুন রেকর্ড হয়েছে। এদিন ১১ হাজার ৭০৫ জন কভিড রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগের দিন শনিবার শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৯২৫। রোববার ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের দিন মৃত্যু হয়েছিল ৪৭ জনের।
কভিড মহামারিতে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে পর্যুদস্ত হয়েছিল ইতালি। এ অঞ্চলে ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যের পর ইতালিতেই সবচেয়ে বেশি- ৩৬ হাজার ৫৪৩ জনের- মৃত্যু হয়েছে। ইতালির সরকার দেশজুড়ে দুই মাসব্যাপী কঠোর লকডাউন জারি করে গ্রীষ্ফ্মের মধ্যে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তবে প্রাদুর্ভাবের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর এখন কর্তৃপক্ষ লকডাউন এড়াতে চাইছে। এ জন্য বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা, রেস্তোরাঁ ও জনসমাগমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে তারা।
বেলজিয়ামে গতকাল সোমবার থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। দেশটির ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ চার সপ্তাহ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ব্যান্ডেনব্রাউক বলেছেন, করোনার নিয়ন্ত্রণ এখন আর তাদের হাতে নেই। বেলজিয়ামে মাথাপিছু হিসাবে আক্রান্তের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। গত এক মাসে দেশটিতে কভিড রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দুই লাখ ২২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আগের সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ ৭৯ শতাংশ বেড়েছে। গত মঙ্গলবার সেখানে ১২ হাজার ৫১ জন কভিড রোগী শনাক্ত হয়, যা এ মহামারিতে এক দিনে সর্বোচ্চ।
পোল্যান্ডের বড় শহরগুলোতে স্কুল-কলেজ ও রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আয়ারল্যান্ডে রেস্তোরাঁ ও পানশালা এক মাসের জন্য বন্ধ করার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে। জার্মানিতে এক দিনে সাত হাজার ৮৩০ জন আক্রান্ত হওয়ার পর দেশটির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল নাগরিকদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভেনিয়ায় সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। নিউজিল্যান্ড দু’দফায় করোনাকে পরাজিত করলেও সেখানে আবার সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সুইজারল্যান্ড এত দিন কোনো ধরনের কড়াকড়ি ছাড়া চললেও এবার সেখানেও ঘরের বাইরে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত সপ্তাহে সেখানেও সংক্রমণের হার দ্বিগুণ হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যালেইন বার্সেট বলেছেন, আগেভাগেই এবং জোরেশোরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। স্লোভাকিয়া সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১০ বছরের ওপর সবার করোনা পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছে। দেশটির জনসংখ্যা ৫৪ লাখ।
ইউরোপের সবচেয়ে সংক্রমিত পাঁচটি দেশ- ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের সমান। অথচ ওই দেশগুলোতে এক সপ্তাহে সংক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি ছিল।
এদিকে, ইরানে এক দিনে ৩৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটাই দেশটিতে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ মৃত্যু। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে বিপন্ন দেশটিতে করোনার তৃতীয় ঢেউ চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশটিতে করোনায় ৩০ সহস্রাধিক লোকের প্রাণ গেছে।
মালয়েশিয়ায় রোববার করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। এ দিন দেশটিতে নতুন করে আরও ৮৭১ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর এটিই এক দিনে সর্বোচ্চ শনাক্তের ঘটনা। মালয়েশিয়ায় এখন পর্যন্ত মোট ২০ হাজার ৪৯৮ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত মঙ্গলবার থেকে রাজধানী কুয়ালালামপুর, সাবাহ রাজ্যসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। সূত্র :বিবিসি।