পৃথিবীতে কী হয়, যখন সরকার এবং ধর্মীয় মৌলবাদি দল কোনও লেখকের বিরুদ্ধে উন্মাদ হয়ে তার সবরকম সর্বনাশ করতে থাকে, তখন প্রগ্রেসিভ মিডিয়া এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়ায়। আমার বেলায় তা হয়নি।
আমি বাংলাদেশে বাস করা কালীন জনপ্রিয় একজন লেখক ছিলাম, আমার বই ছাপানোর জন্য প্রকাশকেরা বাড়িতে এসে অনুরোধ করতো, অগ্রীম রয়াল্টি দিয়ে যেত। সেই আমার বিরুদ্ধে যখন সরকার এবং মৌলবাদিরা একজোট হয়ে আমার ক্ষতি করতে শুরু করলো, আমার পাশে যাদের থাকার কথা, তাদের অধিকাংশই পাশে থাকলো না। তারাও মহা আনন্দে ক্ষতি করতে শুরু করলো।
বাংলাদেশের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাটিকে প্রগ্রেসিভ পত্রিকা বলে ধরা হয়। এর প্রকাশক এবং সম্পাদক এককালে কমিউনিস্ট ছিলেন বলে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু তাঁর পত্রিকায় তিনি আমার বিরুদ্ধে নিম্নমানের মৌলবাদি পত্রিকা ইনকিলাব, সংগ্রাম, মিল্লাত ইত্যাদিতে যেরকম নিম্নমানের কুৎসা ছাপা হতো সেরকম কুৎসা ছাপানো শুরু করলেন।
লোকটির জন্য দুঃখ হয় আমার। কী করে এত বড় বিবেকহীন হলেন তিনি। কী আনন্দ তাঁর জোটে একজন লেখক, যে লেখককে দেশে ঢুকতে দেয় না সরকার, যে লেখকের মুণ্ডু চেয়ে মৌলবাদিরা ফতোয়া দেয়, যে লেখককে কুপিয়ে মারার জন্য জিহাদিরা রাম’দা হাতে খাড়া, যে লেখক স্ট্রাগল করছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লেখালেখি করছে, কিন্তু আপোস করছে না কোনও অন্যায়ের সঙ্গে, অসভ্যতার সঙ্গে, অমানবিকতার সঙ্গে , তাঁকে অবিরাম অপদস্থ করতে, অপমান করতে!
সম্পাদক মতিউর রহমানের তসলিমাবিদ্বেষ এত চরম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আজ তিনি এমন উদ্ভট একটি লেখা ছাপালেন তাঁর পত্রিকায়, যে, ঘটে এক ছটাক বুদ্ধি যাদের আছে, তাদেরও এ লেখাটিকে হাস্যকর বলে মনে হবে।
তিনি বলতে চাইছেন, তসলিমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মৌলবাদি আন্দোলন যা হয়েছে, তা তসলিমা করিয়েছে। কোনও এক বইমেলায় নাকি বোমা ফাটিয়েছি আমি, নিজের কাপড় চোপড় নিজেই ছিঁড়েছি, আমার নিজের প্রচারের জন্য। তিনি এসব লিখেছেন সমরেশ মজুমদারের বরাত দিয়ে। উনি নাকি প্রথম আলোকে বলেছিলেন এসব। তো সমরেশ মজুমদারের মৃত্যুর পর এই স্মৃতিটাই কেন সম্পাদকের কাছে মনে হলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ?
সম্পাদক কি মনে করেন সমরেশ মজুমদার সত্য বলেছিলেন? না, তিনি খুব ভালো করে জানেন সমরেশ মজুমদার ভালো লেখক হলেও মিথ্যুক লোক ছিলেন। আমার সম্পর্কে যা তিনি বলেছেন সব যে ডাহা মিথ্যে, তা সম্পাদকমশাইয়ের অজানা নয়। দেশ জুড়ে মাসের পর মাস তসলিমাবিরোধী লক্ষ মানুষের তাণ্ডব কী করে হচ্ছে কেন হচ্ছে সে সম্পর্কে একজন সাংবাদিক কিছুই জানবেন না তা হয় না। অন্য দেশ থেকে এক লোক প্রথমবার এ দেশে বেড়াতে এসে বইমেলায় কী ঘটেছে তা জানবেন, কিন্তু বড় পত্রিকার বড় সম্পাদক হয়ে বইমেলায় কী ঘটেছে জানবেন না, তা তো সম্পাদকের জন্যই অপমান জনক। সেদিন, সেই বইমেলা নিয়ে এমন কোনও রিপোর্ট কি সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন যে বইমেলায় নিজের প্রচারের জন্য তসলিমা বোমা ফাটিয়েছে এবং নিজের কাপড় নিজে ছিঁড়েছে? এমন কিছু তো তিনি কখনও ছাপাননি!
বাংলাদেশের বইমেলায় আমি যতবারই গিয়েছি, কোনওবারেই বোমা ফেটেছে শুনিনি, মৌলবাদিদের রোষের শিকার হয়েছি, কিন্তু আমার কাপড় চোপড় কেউ ছেঁড়ে নি।
তবে জানি, সমরেশ মজুমদারের উপকার করেছিলাম খুব, সে কারণে তিনি আমার অপকার করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। এসব ১৯৯১ বা ১৯৯২ সালের কথা। তিনি বাংলাদেশে প্রথম যখন এলেন তখন তাঁর সাক্ষাতকার নিতে আমি বিভিন্ন পত্রিকাকে অনুরোধ করেছিলাম, এবং তাঁর বই ছাপাতে বিভিন্ন প্রকাশককে অনুরোধ করেছিলাম। তাঁকে প্রকাশকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, এবং ঢাকার বইমেলা কেমন হয় দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম বইমেলায়। এসব তাঁর এমনই উপকারে লেগেছিল যে তিনি তারপর আমি নির্বাসনে থাকাকালীন বাংলাদেশে কিছুকাল যাতায়াত করে বুঝে যান , আমার নিন্দে করলে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা বাড়ে।
নিজে পাঁড় মদ্যপ অথচ লোকের কাছে বলে বেড়াতেন আমি নাকি মদ্য পান করে প্রতিদিন বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকি, অথচ মদ্যপান কী করে করতে হয়, সেটাই এখনও অবধি ঠিক জানিনা । অপকার করার জন্য তিনি দেশ পত্রিকায় সম্পদককে দিনের পর দিন অনুরোধ করে আমার বিরুদ্ধে এক রাশ মিথ্যের ঝুড়ি উপুড় করে ছাপিয়েছিলেন। বড় লেখক লিখেছেন সুতরাং তাঁর সব কথা সত্যি। এভাবেই তো বাংলার মানুষ ভাবে, কে আর যুক্তি বুদ্ধি বিবেক দিয়ে বিচার করে, কে আর তদন্ত করে সত্য বের করে।
এক জীবনে কী ভীষণ ঘৃণার, মিথ্যের, হিংসের বীভৎস চেহারা দেখলাম। সরকার আর মৌলবাদি দলের শত্রুতা দেখলে অবাক হই না, অবাক হই প্রগতিশীল নামধারী এইসব হিপোক্রিটদের অপপ্রচার দেখে। কী আনন্দ এরা পায় একজন সৎ মানুষের বিরুদ্ধে অসৎ হতে। আমি নিশ্চিত আমি পুরুষ হলে এরা এত বর্বর আচরণ করতো না, আমি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব না হলে এরা এদের ধারালো দাঁত এত দেখাতো না।