The news is by your side.

একটি সুন্দর সকাল ও মমতা ব্যানার্জীর কবিতা

0 347

 

 

জারিন তাসনিম

সকালটা শুরু হলো অসাধারণভাবে। মেঘলা আকাশ, দমকা হাওয়া, রবীন্দ্রনাথের গান আর মমতাদি’র কবিতা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সম্প্রতি বাংলা ভাষায় নিরলস ও নিরলস সাহিত্যচর্চার জন্য ‘বাংলা আকাদেমি পুরস্কার’-এ ভূষিত হয়েছেন। সেই সুবাদেই মমতা’দির কবিতা পড়ছিলাম। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো অন্য জায়গায়। একটি কবিতা পাঠ করার পর অন্য কবিতাগুলো পাঠ করার ইচ্ছা প্রচণ্ডভাবে জেঁকে বসলো। ধীরে ধীরে নিজের ভেতর এক অদ্ভুত পরিবর্তন টের পেলাম। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা—একটি কবিতা পাঠ করার পর আমি মমতাদি’র কাব্যরসে আসক্ত হয়ে গেছি। হলফ করে বলতে পারি এমন অদ্ভুত সম্মোহনীযুক্ত সাহিত্যমাখা কবিতার জন্ম  বাংলা ভাষায় খুব একটা হয়নি।

এরপর থেকে সারা সকাল আমি কেবল কবিতাই পড়েছি। পড়তে পড়তে কখনো হেসেছি, কখনো আবার একাই কেঁদে উঠেছি। জে.ডি. স্যালিঞ্জারের দীর্ঘদিন পর মমতা ব্যানার্জী তাঁর শক্তিশালী লেখা দিয়ে একই সাথে হাসালেন এবং কাঁদালেন। এ কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করা মতো নয়।

মমতাদি’র লেখা আমার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা ‘পিংপং’ থেকে দুটো লাইন তুলে দিচ্ছি।

‘পিং পং

কালিমডং

ডিং ডং

কালিমডং

কিংকং

কালিমডং’

এছাড়াও অনারেবল মেনশন হিসেবে বলতে পারি ‘হামবা’ কবিতার কথা।এ কবিতাটি ইতিমধ্যে একজন ভদ্রমহিলা ফেসবুকে পাঠালোচনা করেছেন, আপনাদের কেউ কেউ এর সাথে পরিচিত থাকতে পারেন।

‘হরে করো কমবা,

গরু ডাকে হামবা।

গর্জন করে অম্বা,

মা ডাকেন বুম্বা।’

 

এ কবিতাগুলো আপাতদৃষ্টিতে সহজপাঠ্য হলেও সহজপাচ্য নয়। বাংলার বিশাল সাহিত্য সম্ভারে এদের অন্তনির্হিত তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার কবিতা ভাণ্ডারে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানদের পর সর্বশেষ সংযোজন মমতা ব্যানার্জী।

মমতা ব্যানার্জী’র লেখা অনেকগুলো কবিতা পাঠ করার পর আমার মনে হলো, জ্ঞানের আনন্দ সবার ভেতর ছড়িয়ে দেওয়া উচিৎ। ঠিক এ কারণেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মমতা ব্যানার্জীর লেখা আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি কবিতা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী ও গঠনমূলক আলোচনা করবো। আলোচনার পূর্বে   একটা কথা জানিয়ে রাখা অত্যন্ত  জরুরি। এ কথা আমি অকপটে স্বীকার করে নেই,কবিতা ব্যবচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট যোগ্যতা ও মেধা কোনোটিই আমার নেই—তবু প্রিয় কবি ও কবিতার জন্য এতটুকু ঝুঁকি নেওয়াই যায়।

 

কবিতার নাম—’নাম’

মমতা ব্যানার্জী

 

তোমার নাম? হ্যালো-হাই

বাবার নাম? সি ইউ বাই

মায়ের নাম? হাই ফাই

বোনের নাম? সুইটি পাই।

যাচ্ছো কোথায়? ফেস্ট করতে।

ফিরবে কখন? ঘুমঘুমোতে,

খাবার মেনু? চিপস ঠাণ্ডাতে।

শরীর কেমন? একেবারে স্লিম,

শরীর চর্চা কর, আছে তো জিম।

এতো রোগা? ওটাই তো ড্রিম

অসুখ করলে? আছে মেডিক্লেম।

 

কবিতার স্ট্রাকচার থেকে প্রথমেই প্রশ্নবোধক চিহ্নকে মধ্যাবস্থায় রেখে আমরা সম্পূর্ণ পংক্তিগুলোকে দুটো অংশে ভাগ করতে পারি। প্রথম অংশে আছেন প্রশ্নকর্তা বা কনভারসেশন ইনিশিয়েটর, এবং দ্বিতীয় অংশে আছেন উত্তরদাতা। তাদের ভেতর সম্পর্ক কী, কথোপকথনের স্থান, কাল, পাত্র কোনোকিছুই কবি স্পষ্ট করে বলেননি।

এখন আমরা সরাসরি চলে যাচ্ছি পংক্তিতে। প্রথম লাইন ‘তোমার নাম? হ্যালো-হাই’ দ্বারা কবি বোঝাতে চেয়েছে গ্রিটিংস বা অভিবাদনের গুরুত্ব। প্রশ্নকর্তা প্রথমেই একজনের নাম জানতে চেয়েছেন। অথচ হুট কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আগে অভিবাদন জানানোর মতো ন্যুনতম কার্টসি আমাদের সবার থাকা উচিৎ। লক্ষ্য করুন, প্রশ্নকর্তার ভেতর তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। ঠিক এ কারণেই উত্তরদাতা হাই/হ্যালোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন৷

আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে উত্তরদাতার নাম আব্দুল ‘হাই’ হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা আছে। প্রশ্নকর্তা হাই/হ্যালো কিছু না বললেও উত্তরদাতা ‘হ্যালো’ বলে তার নাম জানিয়েছেন।

দ্বিতীয় লাইনে প্রশ্নকর্তা জানতে চেয়েছেন বাবার নাম, উত্তরদাতা বলেছেন ‘সি ইউ বাই’। এর অর্থ হলো, বাবার নাম জানতে চাইবার পর উত্তরদাতা উত্তর দেবার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যক্তিত্ববান উত্তরদাতা মনে করিয়ে দিতে চান, বড় হতে হবে নিজের পরিচয়ে,বাবার পরিচয়ে নয়। তাই তো তিনি বাবার নাম বলতে কুণ্ঠাবোধ করছেন। এখান থেকে আমরা চমৎকার ব্যক্তিত্ব গঠনের আহবান পেয়ে থাকি।

মায়ের নাম জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছেন ‘হাই-ফাই’। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় উত্তরদাতার মা খানদানি বংশের কোনো ভদ্রমহিলা। তবে তিনি যেহেতু বাবার পরিচয় লুকিয়ে মায়ের পরিচয় দিচ্ছেন, তাই আমরা বুঝতে পারি উত্তরদাতা একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকে এসেছেন। তিনি মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এই পংক্তির মাধ্যমে আমরা পুরুষতান্ত্রিকতাকে মোকাবিলা করার এক প্রচ্ছন্নশক্তি পেয়ে থাকি।

একইভাবে,বোনের নামের উত্তরে তিনি জানান ‘সুইটি পাই’। হতে পারে ভদ্রলোকের বোনের নাম সুইটি, এবং যেহেতু তিনি এর কথা বলেছেন, বোনটি নিশ্চয়ই গণিতে ভীষণ ভালো। মেয়েরা গণিতে তেমন ভালো হয়না—এমন ধারণা আমাদের সমাজে আজও বিদ্যমান। সেই ধারণাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গর্বিত ভাই আজ তার বোনের কথা জানাচ্ছেন। এছাড়াও, অল্প কথায় অনেক কথা বলার যে কৌশল তা আমরা উত্তরদাতার কাছ থেকে শিখতে পারি।

এভাবেই প্রতিটি কবিতার প্রতিটি লাইনের প্রতিটি শব্দে মমতা ব্যানার্জী আমাদের শিখিয়ে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীন, উপহার দিয়ে যাচ্ছেন অসাধারণ কিছু সাহিত্যকর্ম। একইসাথে ছন্দ ও ভাবনির্ভর কবিতা নির্মাণের যে কলাকৌশল, তা দিদির আগে কেউ দেখাতে পারেননি। বাঙালি হয়ে জন্মগ্রহণ করায় আজ সত্যিই আমি আনন্দিত ও সার্থক। এমন কবিতা পড়ার জন্য বারবার বাংলায় জন্ম নেওয়া যায়।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.