ড. আতিউর রহমান
আজ স্বাধীনতা দিবস। মনে বাজছে শামসুর রাহমানের সেই অমর কবিতা-‘স্বাধীনতা তুমি’। এই কবিতার প্রতিটি শব্দ একাত্তরের গভীর সব অনুভূতির কথা বলে। বলে,“স্বাধীনতা তুমি রবীঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।” আরও বলে কাজী নজরুলের ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো’ সৃষ্টি সুখের উল্লাসের কথা। বলে ‘ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি’ আর ‘রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার’ -এর কথা। আহা স্বাধীনতা কতোই না তোমার ব্যঞ্জনা! আমরা যারা পরাধীনতা ও স্বাধীনতা- দুই সময়ের মাঝেই বড় হয়েছি তারা ঠিকই বুঝি স্বাধীনতার মর্মবাণী। ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়?’ এটিই হচ্ছে চিরন্তন সত্যি।
এই স্বাধীনতা এমনি এমনি আসে নি। কতো শহীদের রক্তে সিক্ত এই স্বাধীনতা। কতো মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা।কতো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার অঙ্গের দামে কেনা এই স্বাধীনতা। আমাদের নতুন প্রজন্ম এই স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বপনকারী সেই ‘দীঘল পুরুষের’ কথা কতোটাই বা জানে? দিনের পর দিন কারা অন্তরালে থাকা রাজনীতির এই বরপুত্রের কষ্টের তল ক’জনেই বা স্পর্শ করতে পেরেছি আমরা? একেবারে শূণ্য থেকে স্বদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার দুঃখের ও সুখের স্মৃতিকথা কতোটাই বা আমরা জানি।
তীব্র ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্যের যাতনায় কাতর বাংলাদেশকে মাত্র সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় কীভাবে আশাবাদী এক স্বপনের মহাসড়কে তুলে দিয়ে গেছেন বাঙালি জাতির পিতা তা ক’জনেই বা মনে রেখেছেন। অথচ এ কথাটি তো সত্যি তাঁর রক্তে এই বাংলার মাটি উর্বর হয়েছে বলেই না আজ আমরা সবাই দুবেলা পেট পুরে খেতে পারছি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে গত ১৪ বছরে নব্বই বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে আমরা ৪৬৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে পেরেছি।গত বাহান্ন বছরে যতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার ৭০ শতাংশের বেশি হয়েছে বিগত এই ১৪ বছরে।
এ যাবৎ মোট রপ্তানির ৬১ শতাংশ, আমদানির ৬৯ শতাংশ এবং প্রবাসী আয়ের ৬০ শতাংশ অর্জন করা গেছে এই সময়টাতেই। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার নেতৃত্বের পরম্পরায় আমাদের পরিশ্রমী কৃষক, শ্রমিক, ক্ষদে ও মাঝারি উদ্যোক্তার কল্যাণে আজ আমরা খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের স্বাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশেরও বেশি, দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশেরও কম (বাহাত্তরে যা ছিল আশি শতাংশ), আমাদের জীবনের গড় আয়ু এখন তিয়াত্তর বছর (বাহাত্তুরে ছিল ৪৭ বছর), শিশু মৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ার হারের অর্ধেক। সারা বাংলাদেশ আজ পাকা রাস্তায় এমনভাবে যুক্ত যে একদিন বা আধা দিনেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পৌঁছোনো যায়। নিমিষেই মোবাইলে টাকা পাঠানো যায়।
তা সত্ত্বেও আছে দুঃখ। আছে কষ্ট। আছে নানা অবিচার, অন্যায় ও অসংগতি। আর দুর্নীতির কথা নাই বা বললাম। তবু হতাশ হবার সময় নয় এটি। ভূরাজনীতির এক ঘূর্ণিপাকের মধ্যিখানে আমাদের আজ অবস্থান।
খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে আমাদের। এমন এক ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে এতো কষ্টে পাওয়া এই স্বাধীনতাকে আমাদের অপরিনামদর্শী আবেগে ও আচরনে বিপর্যস্ত করতে পারি না। কেননা এই স্বাধীনতা আমাদের অস্তিত্বের আরেক নাম। আমাদের বেঁচে থাকার অজেয় প্রাণশক্তি। আমাদের আত্মশক্তি বিকাশের অমূল্য আধার। আমাদের স্বপ্ন দেখার এক মোহনীয় লক্ষ্যবস্তুর নাম। স্বাধীনতা তুমি টিকে থাকো। বেঁচে থাকো যুগ-যুগান্তরে। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবি হোক। সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।