বিশ্বের ‘সবচেয়ে প্রাণঘাতী ড্রোন’। এই নামেই পরিচিত ‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’। সেই মারাত্মক ‘মারণদূত’কে এ বার ভারতের হাতে তুলে দিতে চলেছে আমেরিকা। বৃহস্পতিবার ভারতকে ৩১টি প্রিডেটর ড্রোন দেওয়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকার জো বাইডেনের সরকার। শীঘ্রই ভারতের সামরিক বাহিনীর অস্ত্রাগারে ঠাঁই পাবে ড্রোনটি।
শত্রুদের উপর নজর রাখতে ‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’ ড্রোনের জুড়ি মেলা ভার। উড়তে উড়তেই শত্রুপক্ষের গতিবিধির উপর নজর রাখতে সক্ষম এই ড্রোন।
সেই ড্রোন এতটাই অত্যাধুনিক যে, তার ‘চোখে’ কী ধরা পড়ছে, তা আবার দেখতে পাওয়া যায় দু’হাজার কিলোমিটার দূরে বসে। প্রয়োজন পড়লে সেই প্রযুক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ‘গুপ্তচর’ ড্রোনকে বদলে ফেলা যায় ‘ঘাতক’ ড্রোনে। একটি বোতাম টিপলেই ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাতে পারে ‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’। ধ্বংস করতে পারে শত্রুপক্ষের ডেরা।
‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’কে সামরিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বিশ্বের ‘সবচেয়ে প্রাণঘাতী ড্রোন’ বলে মনে করেন। এর অপর নাম ‘রিপার ড্রোন’।
প্রায় ছ’বছর আগে অর্থাৎ, আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় প্রিডেটর ড্রোন কেনা নিয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা প্রকাশ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার। বছর দেড়েক আগে সে বিষয়ে ‘ইতিবাচক’ সমঝোতায় পৌঁছয় দুই দেশ। গত জুন মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের উপস্থিতিতে ‘প্রতিরক্ষা ক্রয় পর্ষদ’ (ডিফেন্স অ্যাকিউজিশন কাউন্সিল)-এর ড্রোন কেনার বিষয়ে চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
আমেরিকা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েছে, ভারতের হাতে ৩১টি প্রিডেটর ড্রোন তুলে দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছে আমেরিকা কংগ্রেস। আনুষ্ঠানিক ভাবে আগামী মাসে সেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
সূত্রের খবর, ভারতীয় সেনার জন্য প্রায় ৩৯৯ কোটি ডলার (প্রায় ৩৩,১১৬ কোটি টাকা) খরচ করে কেনা হচ্ছে প্রিডেটর সিরিজের আধুনিকতম সংস্করণ।
ভারতের হাতে যে ৩১টি প্রিডেটর ড্রোন থাকবে, তার মধ্যে ১৫টি পাবে ভারতীয় নৌসেনা। সেই ড্রোনগুলির নাম হবে ‘সি গার্ডিয়ান’। বায়ুসেনা এবং পদাতিক বাহিনী পারে আটটি করে ‘স্কাই গার্ডিয়ান’ প্রিডেটর ড্রোন।
তবে এমনটা নয় যে, এই প্রথম ভারতের হাতে ঘাতক ড্রোন আসছে। পূর্ব লাদাখের গলওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর আমেরিকার কাছ থেকে দু’টি ‘এমকিউ-৯বি সি গার্ডিয়ান’ ড্রোন লিজ় নিয়েছিল নয়াদিল্লি।
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনা কার্যকলাপের উপর নজর রাখতে ড্রোনগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। পরবর্তী কালে লিজ়ের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়।
ভারতের সামরিক অস্ত্রাগারে নতুন এই ড্রোনের অন্তর্ভুক্তি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। এর ফলে ভারতীয় সেনার পক্ষে জঙ্গিদের গোপন ডেরায় অভিযান চালানো আরও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, লাদাখের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় চিনের সঙ্গে বিবাদের আবহে ড্রোনটি সেনার পক্ষে অত্যন্ত কার্যকরী হবে বলেও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান।
কিন্তু কেন ‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’ ‘সবচেয়ে প্রাণঘাতী’? অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন প্রিডেটর ড্রোনের অন্যতম শক্তি হল সেটির গতি। ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৪৪২ কিলোমিটার বেগে ছুটে যেতে পারে ড্রোনটি।
নিশ্চুপে কার্যসিদ্ধির জন্যও নামডাক রয়েছে ‘প্রিডেটর এমকিউ-৯বি’-র। মাত্র ২৫০ মিটার উঁচু দিয়ে চলাফেরার সময়ও টুঁ শব্দ পর্যন্ত করে না এই ড্রোন। মাথার উপর ড্রোন ঘুরঘুর করার আভাস পায় না শত্রুরা। ‘এমকিউ-৯বি’র এই চরবৃত্তিই একে অন্য প্রাণঘাতী ড্রোনদের থেকে আলাদা করে।
সব থেকে কম ২৫০ মিটার ওপর থেকে নজরদারি চালাতে সক্ষম ড্রোনটি সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। অর্থাৎ, যে কোনও বাণিজ্যিক বিমানের চেয়েও উঁচুতে ওড়ে এই ড্রোন।
‘এমকিউ-৯বি’ প্রিডেটর ড্রোনটি জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রায় তিন হাজার কিমির বেশি ভ্রমণ করতে পারে। ৩৫ ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত উড়তেও পারে।
পাশাপাশি শিকারি ড্রোনটি চারটি ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রায় ৪৫০ কেজি বোমা-সহ প্রায় ১৭০০ কেজি ওজন বহন করতে সক্ষম।
প্রিডেটর ড্রোনে ‘আকাশ থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি ‘আকাশ থেকে ভূমি’ ক্ষেপণাস্ত্রও রাখা যায়।
‘এমকিউ-৯বি’ প্রিডেটর ড্রোনের যে সংস্করণ নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা হয়েছে অর্থাৎ, ‘দ্য সি গার্ডিয়ান’-এ অত্যাধুনিক রাডার এবং ‘সোনোবুয় মনিটরিং সিস্টেম’ রয়েছে যা এটিকে ডুবোজাহাজের খোঁজ দিতে পারে।
উল্লেখযোগ্য যে, নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং জঙ্গি ডেরায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য প্রিডেটর ড্রোন ব্যবহার করে আমেরিকা।
তালিবান প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মহম্মদ ওমর, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের প্রধান বায়তুল্লা মেহসুদ, সিরিয়ার আল কায়দা প্রধান সেলিম আবু আহমেদ থেকে হালফিলে ইরানের জেনারেল কাশেম সোলেমানি এবং আল কায়দা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরি হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছিল এই ‘এমকিউ রিপার ড্রোন’।
আমেরিকা ছাড়া সম্প্রতি এই প্রিডেটর ড্রোন ব্যবহার করছে ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের বিমানবাহিনী।