তসলিমা নাসরিন
প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় যে টার্গেট মার্কেট চলে, আমার জানা ছিল না। আমার জানা ছিল না যে হাসপাতালের পরিচালকেরা ডাক্তারদের আগেই টার্গেট দিয়ে দেন যে এতগুলো সার্জারি চাই মাসে, এতগুলো টেস্ট চাই, এত কোটি টাকা চাই।
শুনেছি টার্গেট পুরণ করতে না পারলে ডাক্তারদের চাকরি থাকে না। শুনেছি, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তারদের মাইনে কম , কিন্তু নানা রকম কমিশন এবং নানা পারসেন্টেজের হিসেবে মাসের শেষে টাকার পরিমাণ সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের চেয়ে প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তারদের অনেক বেশি ।
বড় করপোরেট হাসপাতালে বসে মোটা অংকের টাকা উপার্জন করতে হলে কিছু রোগিকে রেভিন্যু টার্গেটের ভিক্টিম বানাতে হয় ডাক্তারদের। দুর্ভাগ্য আমার, আমি অ্যাপোলো ইন্দ্রপ্রস্থ নামের বড় এক করপোরেট হাসপাতালের টার্গেট মার্কেটের ভিক্টিম হয়েছি।
আমার জানা ছিল না বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় ম্যালপ্র্যাক্টিসের ভিক্টিমদের সত্যিকারের টেস্ট রেজাল্ট, রোগির সত্যিকারের হিস্ট্রি —- সব কিছুকে লুকিয়ে ফেলে একরাশ মিথ্যে লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মেডিক্যাল ক্রাইম যেন ধরা না পড়ে সেজন্য এক্সরে, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি জালিয়াতি করে বদলে দেওয়া বা ফেব্রিকেট করার ব্যবস্থা আছে আমার জানা ছিল না।
আমার জানা ছিল না কোনও দামি ইমপ্লান্টের কথা বলে সস্তা ইমপ্লান্ট শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলে এখানে। দুর্ভাগ্য আমার, আমি বড় এক প্রাইভেট হাসপাতালে ভয়ংকর এক চক্রান্তের শিকার হয়েছি।
ধীরে ধীরে আমি জেনেছি, যে রোগ আমার কোনকালেই ছিল না, যে রোগ আমার ধারে কাছে কোনওদিন ঘেষেনি, যে রোগ আমার নেই, যে রোগ আমার হবে না, সেই রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে আমাকে ভুল বুঝিয়ে, মিথ্যে বলে, ফাঁকি দিয়ে, চক্রান্ত করে। এক লোভী এবং অসৎ সার্জন আত্মীয়পরিজনহীন একা আমাকে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই চটজলদি আমার সুস্থ শরীর থেকে শরীরের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ কেটে ফেলে দিয়ে আমার রোগশোকহীন স্বনির্ভর জীবনের চিরসমাপ্তি ঘটিয়ে দিয়েছে।
কেউ আমার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার আগে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেউ ভিজিট করার আগে, এক্সরে রিপোর্ট আমি দেখার আগে, সিটি স্ক্যান রিপোর্ট হাতে আসার আগে লোকটি এই দুষ্কর্মটি করেছে, যেন টার্গেট পুরণ করার সুযোগ হাত ফসকে বেরিয়ে না যায়। জল্লাদের নাম (লোকটিকে ডাক্তার বলতে আমার বাধে) ইয়াতিন্দার খারবান্ডা।
আমার দুঃখ এই, আমার যা বয়স ছিল, সেই বয়সকে তিরিশ বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যভাবে আমার জীবনের আয়ু করপোরেট ক্রিমিনালরা তিরিশ বছর কেড়ে নিয়েছে। যে জীবন আমি যাপন করতে বাধ্য হচ্ছি, সেটি একটি অনাকাঙ্ক্ষিত জীবন।
আমি জানি জিহাদিরা তুমুল আনন্দ করবে আমার দুর্ভোগ নিয়ে, আমি জানি শুভাকাঙ্ক্ষীরা বলবে, আমি যেন ওভারকাম করি এই দুঃস্বপ্নকে, এই হাহাকারকে; আমার মনোবল প্রচুর, আমি যেন চমৎকার বাঁচি। আমি কী করে বেঁচে থাকবো বাকি জীবন আমি জানি না। তবে জীবনের সমস্ত রকম উপলব্ধিকে, সত্যকথনকে , কার্পেটের আড়ালে রেখে শুধু লোক দেখাতে নেচে উঠবো হেসে উঠবো এমন তো আমি নই। ছিলাম না কখনও।
সত্য নির্মম হলে প্রকাশ করেছি, সত্য মধুর হলেও প্রকাশ করেছি। অন্যকে যেমন ফাঁকি দিতে পারি না, নিজেকেও আমি ফাঁকি দিতে পারিনা।