The news is by your side.

আত্মজীবনী: অল্প স্বল্প দীর্ঘজীবন- ৬২

0 302

 

 

আফজাল হোসেন

আমি নলতা বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, নলতা মাল্টিলেটারাল হাই স্কুলের ছাত্র। যশোর বোর্ডের অনেক নামডাক অলা স্কুল ছিল সেটা। সে স্কুলে পড়ি শুনলে সবার চোখজোড়া একটু বড় হয়ে যেতে দেখতাম। তার দুটো কারণ ছিল

প্রথম কারণ, পুরো খুলনা জেলার মানুষেরা জানতো, খুবই কড়া নিয়ম কানুনের স্কুল সেটা। কড়া বলেই যারা দুষ্ট প্রকৃতির, বাবা মা সামলাতে পারতেননা যাদের- তাদেরকে ঐ স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সঙ্গত কারণেই সে স্কুলের ছাত্র জানলে চমকে যাওয়া বা চোখ বড়ো হয়ে যাওয়ারই কথা।

দ্বিতীয় কারণ, সেটা দুষ্টদের দুনিয়া হলেও রেজাল্টের হিসাবে যশোর বোর্ডের সবচেয়ে নামকরা স্কুল। ঐ স্কুলে যারা পড়তে যায় বা যাদেরকে হাত পা বেঁধে সেখানে পাঠানো হতো, তাদের অধিকাংশই দীর্ঘ কারাবাসের  পর- সুনাম, সন্মানের সাথে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঘরে ফিরতো।

তেমন হলেও আব্বা আম্মার দোষ ছিলনা। তবে তাঁরা বিশ্বাস করতেন, তাঁদের সন্তান পড়াশোনায় মনোযোগী নয়, সামান্য মনোযোগী হলে দুশ্চিন্তা করার কিছুই থাকতোনা।

পরীক্ষা দিতে যে স্কুলে যাই, সেটা একটু শহর পেরিয়ে। আমাদের সাতক্ষীরার বাড়ি থেকে সাত আট মিনিট লাগে যেতে। স্কুলটা ছিল ধানক্ষেতের মধ্যে। তখন ধান কাটা হয়ে গেছে। জানালার পাশে আমার বসার জায়গা – সেটা আমার ভালো লেগেছিল।

দেখতে পেতাম আকাশ, পাখিদের ওড়াউড়ি। ছোট্ট একটা ডোবা ছিল, তার পানিতে গাছের ডাল কেটে ডুবিয়ে রাখা- তা দেখে অনুমান করে নেয়া যায়, মাছ ছাড়া আছে সেখানে। প্রায়ই দেখতাম, মাছরাঙা এসে বসে রয়েছে। পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখা বাদ দিয়ে দেখতে ইচ্ছা হতো, মাছরাঙা যে ঝাঁপ দেবে- মাছ ফসকে যাবে, না ঠোঁটের ফাঁকে পেয়ে যাবে।

সেই জানালা বরাবর দূরে ঝাঁকড়া বটগাছ ছিল একটা। উদ্বেগ নিয়ে বাবা মা বা আত্মীয়েরা গাছটার নিচে অপেক্ষা, পায়চারী করতেন। জানালা থেকে সেদিকে তাকালে চোখে পড়ে, অনেক দূর পর্যন্ত জমিতে যেনো নকশার মতো সাজিয়ে রাখা আছে কেটে নিয়ে যাওয়া ধানগাছের গোলগোল গোড়াগুলো। আলের পাশে সরু গাছের ছড়ানো ডালে ঘুঘু এসে বসে ডাকতো। সেই ডাক শুনে আমার মন পরীক্ষার খাতা থেকে যেতো সরে।

আব্বা বোধহয় দূর থেকে সারাক্ষণই তাকিয়ে থাকতেন। আমি লিখছিনা দেখলেই হাত নেড়ে ইশরায় বলতেন, লেখো লেখো।

পরীক্ষা শেষ হওয়ার সময় হিসাব করে আম্মা বাড়ির দরজায় প্রতিদিন অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যারাই সে রাস্তা ধরে ফিরতো, সবাই চেনা নয়- তবুও আম্মা জিজ্ঞাসা করতেন – তোমার, তোমাদের আইজকের পরীক্ষা কেমন হইলো?

আমাদের পাশের বাড়িটা ছিল ভাড়া দেওয়া। সে পরিবারের দুজন আমার বয়সী আত্মীয় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সে বাড়িতে এসে থাকতো। তারা ফিরলেই আম্মা একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। হাসি ছড়িয়ে তারা বলতো, ভালো হইয়েছে। কোনদিন বড়ো হাসি দিয়ে বলতো, খালাম্মা খুব ভালো হইয়েছে আইজ।

মূল রাস্তা থেকে আমাদের বাড়ির সুরকি বিছানো রাস্তাটায় ঢোকার আগেই মোটরসাইকেলের শব্দে আম্মা বুঝে যেতেন, আমরা আসছি। কুনি খালা একদিন বলেছিলেন, বাড়ির সামনে এসে মোটরসাইকেল থামা পর্যন্ত আপারেবুবুরে দেইখে মনে হইতো, দম বেরুয়ে যাবেনে।

মোটরসাইকেল থেকে নামা মাত্র আম্মার প্রশ্ন, পরীক্ষা কেমন হইলো বাপ। রোজ আমারও একই রকম উত্তর- হইয়েছে। বলেই ছুট। দাঁড়ানোর সময় নেই, কাপড় বদলে নিজের খেয়ালখুশীতে নামার সময় সেটা। ঘড়ি থেমে নেই। সন্ধ্যা নামা মাত্রই হুকুম মানতে হবে বড়দের। পড়তে বসতে হবে। তার আগ পর্যন্ত আনন্দের সময়, উপভোগের সময়।

পঞ্চমদিন পরীক্ষা দিয়ে ফিরেছি। আম্মার একই প্রশ্ন, রোজকার মতো আমার একইরকম উত্তর। শুনেইআম্মা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন – একটাদিনও বলতি পারিসনে পরীক্ষা খুব ভালো হইয়েছে বা ভালো হইয়েছে। কত মানুষির ছেলে মেইয়েদের বলতি শুনি, আমার ছেলেডা একদিনও বলেনা।

 

আব্বা চলনে দ্রুত, ছটফটে, বলনে ধীরস্থির। পরীক্ষা দিয়ে বের হলে কিছুই জানতে চাননা। আমার চেহারা দেখে অনুমান করে নেন। পরীক্ষা দিতে ঢোকার আগে প্রায় রোজই স্কুলের গেটের সামনে থামিয়ে বলতেন – পরীক্ষা ভালো হইলো না খারাপ, সে পরে দেখা যাবেনে। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে, প্রশ্নপত্রের উত্তর যা জানা, খাতায় মন দে লিখে আসবা।

লম্বা বারান্দায় বালতিতে আব্বার জন্য হাতমুখ ধোঁয়ার পানি রাখা থাকে, পাশে চকচকে একটা পিতলের বদনা আর বসার জন্য গোল ছোট একটা জলচৌকি। হাতমুখ ধুয়ে, খেয়ে পারুলিয়ার বাড়িতে চলে যান।

ছেলেকে নিয়ে ফিরবার পর আব্বার মনে হতো, দেরি হয়ে যাচ্ছে- পারুলিয়ায় রোগীদের অসুবিধা হতে পারে। দু দন্ড স্থির হয়ে দাঁড়াতে বা বসতে পারতেননা। থাকতেন তাড়ায়।

আম্মা কান্না না থামালে দেরি হয়ে যেতে পারে, তাই হাত মুখ ধোয়ার জন্য হাতের কাপড় গোটাতে গোটাতে আম্মাকে কান্না থামাতে বলেন আব্বা – কান্নাকাটি কইরতেছো ক্যান, পরীক্ষা সে ভালোই দেছে, মুখ দেইখে বুইঝতি পারোনা!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.