ভিয়েতনামের এক শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যবসায়ীকে ১২.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক জালিয়াতির দায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দেশটির ব্যবসাকেন্দ্র হো চি মিন সিটিতে বিচার শেষে আদালত বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) ট্রুং মাই ল্যান নামের ওই ব্যবসায়ীকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। তিনি রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার ভ্যান থিন ফ্যাট হোল্ডিংস গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাকে অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ ও ব্যাংকিং নিয়ম লঙ্ঘনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
এছাড়া এই মামলায় আরও ৮৪ জন আসামিকে তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ল্যানের স্বামী ও হংকংয়ের ব্যবসায়ী এরিক চু’কে ৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তার ভাতিজিকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ট্রুং মাই ল্যানের বিরুদ্ধে দেশটির সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, ঋণের ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার পুনরুদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই মামলায় ২ হাজার ৭০০ জনকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ১০ জনসহ মোট ২০০ জন আইনজীবী ছিলেন।
মজার ব্যাপার হলো, এই মামলার প্রমাণ মোট ১০৪টি বক্সে সংরক্ষিত আছে, যার ওজন ৬ টন। এই মামলায় ট্রুংসহ মোট ৮৫ জনের বিচার চলছে। যাঁদের সবাই নিজেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেন।
ভিয়েতনামে দীর্ঘদিন কাজ করা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডেভিড ব্রাউন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, কমিউনিস্ট শাসনামলে এ রকম বিচার আগে কখনো হয়নি। আগে এ ধরনের ঘটনাও (অপরাধ) ঘটেনি।’
বলা হচ্ছে, কমিউনিস্ট দলের সাধারণ সম্পাদক নগুয়েন ফু ট্রংয়ের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত এই বিচারকাজ সবচেয়ে নাটকীয়।
নগুয়েন ফু ট্রং মনে করেন, চরম দুর্নীতির কারণে জনগণের ক্ষোভ কমিউনিস্ট দলের একচেটিয়া ক্ষমতার জন্য হুমকি। তিনি ২০১৬ সালে তৎকালীন ব্যবসাবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানের অংশ হিসেবে দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুই উপপ্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। শতাধিক কর্মকর্তাকে কারাগারে যেতে হয়েছে। এখন তাঁদের দলে ঢুকলেন ধনকুবের এই নারী।
মায়ের সঙ্গে প্রসাধনীর ছোট্ট দোকান দিয়ে ট্রুং জীবন শুরু করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অর্থনৈতিক সংস্কারের সূচনা করার পর জমি ও সম্পত্তি কেনা শুরু করেছিলেন, যা ডোই মোই নামে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশকে তিনি একটি বড় হোটেল ও রেস্টুরেন্টের মালিক হন।
অন্যান্য ধনী ব্যক্তির মতোই ট্রুং জমি ও আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল আয় করতে থাকেন। রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবিধা নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমি ব্যবহারের সুবিধা নেন ট্রুং।
২০১১ সাল পর্যন্ত ট্রুং মাই ল্যান হো চি মিন সিটির সুপরিচিত ব্যবসায়ী ছিলেন। পরে তাঁকে তিনটি ছোট ব্যাংককে একটি বৃহত্তর সত্তায় একীভূত করার ব্যবস্থার অনুমতি দেয় সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংক।
ভিয়েতনামের আইনে যেকোনো ব্যাংকে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু সরকারি কৌঁসুলিরা বলছেন, শত শত শেল কোম্পানি ও তাঁর প্রক্সি হিসেবে কাজ করা ব্যক্তির মাধ্যমে ট্রুং আসলে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯০ শতাংশেরও বেশি শেয়ারের মালিক ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লোকদের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন তিনি। এরপর নিজের নিয়ন্ত্রণ করা শেল কোম্পানির নেটওয়ার্কে শত শত ঋণ অনুমোদন করার জন্যও আদেশ দেওয়ার অভিযোগ ছিল এই নারীর বিরুদ্ধে।
আইনজীবীদের মতে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিন বছরের মধ্যে তিনি তাঁর গাড়িচালককে দিয়ে ব্যাংক থেকে নগদ ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (১০৮ ট্রিলিয়ন ভিয়েতনামি ডং) তুলে তাঁর বেজমেন্টে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় অঙ্কের ব্যাংক নোটে এই পরিমাণ অর্থের ওজন দুই টন।
ট্রুং যে ঋণ নিয়েছেন, তা কখনো যাচাই-বাছাই করা হয়নি। ঋণ যাচাই-বাছাই না করার জন্য বড় অঙ্কের ঘুষ দিতেন তিনি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান পরিদর্শক। বর্তমানে তিনি ৫০ লাখ ডলার ঘুষ নেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন।