কক্সবাজার অফিস
দেশের প্রধান পর্যটন নগরী কক্সবাজার। বছরে কোটি পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত হয় বিশ্বের এই দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। পর্যটক ছাড়াও দেশি—বিদেশি শতাধিক আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার এক হাজারের বেশি কর্মকর্তা অস্থায়ীভাবে বাস করেন এই শহরে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে অপরিকল্পিতভাবে সম্প্রসারণ হচ্ছে শহরটি। ফলে বিশ্বমানের পর্যটকবান্ধব নগরী না হয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে শহরটি।
বাৎসরিক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হলেও পর্যটন নগরীকে ঘিরে আলাদাভাবে নজর দেওয়া হয়নি। নেই কেন্দ্রীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। যত্রতত্র ময়লা—আবর্জনা পড়ে থাকে। গড়ে তোলা হয়নি সুয়ারেজ সিস্টেম। পয়োবর্জ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ, প্রধান সড়কের কচ্ছপ গতির সংস্কারে নাজুক নগর জীবন।
অপরিকল্পিত নগরায়ন
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৫০ বছরেও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে উঠেনি কক্সবাজার। পৌর এলাকার হলি ডে মোড় থেকে শুরু করে দক্ষিণে মেরিন ড্রাইভের টেকনাফ সীমান্ত পর্যন্ত ছোট—বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশো হোটেল—মোটেল, গেস্ট হাউজ ও কটেজ গড়ে উঠেছে।
৬টি তারকা হোটেলসহ ২৪টি বড় হোটেল রয়েছে। এছাড়া আড়াই শতাধিক রেস্তোরাঁও আছে এখানে। তবে এসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ—প্রতিবেশ। সমুদ্রের জীববৈচিত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কক্সবাজারের পর্যটন খাতের অধিকাংশ সম্প্রসারণ হয়েছে গত এক যুগে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি পরিবেশ রক্ষা নীতিমালা। যেখানে সেখানে স্থাপনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেক হোটেল নির্মাণ হলেও রাস্তার অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
পরিকল্পিত নগরায়ন না হওয়ায় ইতোমধ্যে কক্সবাজারের প্রধান সড়কের সম্প্রসারণ নিয়েও বেকায়দায় পড়েছে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কারণ সড়কের দুই পাশে ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক পুরোনা স্থাপনা রয়েছে।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, যানজটের কারণে শহরের জনপ্রিয় মার্কেটে যেতেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অগোছালো স্থাপনার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে।’ ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত এক রুলে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। এরপরও সংরক্ষিত এলাকায় নির্মাণ কাজ হয়েছে। এসব এলাকায় ব্যক্তি মালিকানাধীন অনেক জমি রয়েছে। এসবের কোন সুরাহাও হয়নি। আর স্থাপনাগুলো উচ্ছেদেরও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সুয়ারেজ সিস্টেম গড়ে উঠেনি।
হোটেল—মোটেলগুলোর নিজস্ব সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও নেই। দুই লাখ বাসিন্দা ছাড়াও বছরে কোটি পর্যটকের আগমন ঘটে এই পর্যটন নগরীতে। পুরো পৌর এলাকা থেকে দিনে প্রায় ১৪৫ কোটি টন পয়োবর্জ্যের সৃষ্টি হয়। এরমধ্যে ২০ টন সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে পৌর প্রশাসনের। নালার মাধ্যমে বাকী বর্জ্যের শেষ গন্তব্য হয় নদী ও সাগরে; ফলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার বলছে, ‘সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট না থাকা হোটেল—মোটেলগুলোকে প্ল্যান্ট স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে নির্মাণাধীন স্থাপনাগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে সুয়ারেজ প্ল্যান করতে।
সমুদ্র সৈকতের সংরক্ষিত এলাকায় থাকা স্থাপনাগুলো উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্টদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।’ কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর নুরুল আবছার বলেন, ‘হোটেল—মোটেল নির্মাণসহ কক্সবাজার ইতোমধ্যে অপরিকল্পিতভাবে অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। শিগরিরই প্রধান সড়ক সংস্কার কাজ শেষ হবে। আর বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে কাউকে ভবন নির্মাণ করতে দেওয়া হচ্ছে না। কউক এর মাস্টারপ্ল্যানের বাইরে কিছুই হতে দেওয়া হবে না। কক্সবাজার হোটেল—মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘এখানকার হোটেল—মোটেলগুলো নির্মাণের সময়, তৎকালীন সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নির্দেশনা মেনেই স্থাপনা করা হয়েছে। কক্সবাজারে মাস্টার প্ল্যানে যে নির্দেশনা আসবে, আমরা তা অনুসরণ করতে প্রস্তুত রয়েছি’।
যত্রতত্র আবর্জনা, দুর্গন্ধে নাকাল: কক্সবাজার সৈকতের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা সুগন্ধা পয়েন্টের সৈকতে নামলে আবর্জনার স্তুপ জমে থাকতে দেখা যায়। সুগন্ধা পয়েন্টের সামনের বিচে দেখা যায়, খোদ বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির এক পরিচ্ছন্ন কর্মীই আশপাশের এলাকা থেকে ময়লা তুলে এনে এখানে ফেলছেন। শুধু সুগন্ধা পয়েন্ট নয়, পাঁচ তারকা হোটেল কক্স টুডের সামনে—পেছনেও পড়ে আছে ময়লা—আবর্জনা। পাশেই বন বিভাগের বাংলো কল্লোলের সামনে নালায় ময়লা পানি ও আবর্জনা জমে আছে।
বাংলোর পেছনে উর্মি পয়েন্টেও আবর্জনার স্তুপ রয়েছে। এসব আবর্জনা মাড়িয়ে সৈকতে নামতে হয় পর্যটকদের। তবে পর্যটন দিবস উপলক্ষে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন পরিচ্ছন্ন সৈকত গড়ে তুলতে কাজ করছে। এছাড়া কলাতলী থেকে হলি—ডে মোড় পর্যন্ত হোটেল—মোটেল এলাকার দীর্ঘ এ সড়কের দুই পাশের বিভিন্ন স্থানে পড়ে রয়েছে ময়লা—আবর্জনা। এসব আবর্জনা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন এলাকার সৈকতেও। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের পাশাপাশি দূরদূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের। হচ্ছে পরিবেশ দূষণও।
ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন মেহের আফরোজ—আবরার দম্পতি। সুগন্ধা পয়েন্ট থেকে সৈকতে নামতে নাক চেপে ধরেন দুজনেই। মেহের আফরোজের স্বামী আবরার হোসেন বলেন, ‘ভেবেছিলাম কক্সবাজার পরিকল্পিত একটি পর্যটন নগরী। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই দেখি শহরের নালা—নর্দমার বেহাল দশা। যত্রতত্র পড়ে আছে ময়লা—আবর্জনা। এমনকি সৈকতের পাড়েও ময়লা ফেলা হচ্ছে।’ দ্য সি প্রিন্সেস হোটেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল বাশার চৌধুরী বলেন, ‘সৈকতের খুব কাছেই আমার হোটেলটি। হোটেলে বসেই সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের পাশে আবর্জনার স্তুপ হওয়ায় পর্যটকদের নজরে প্রথমেই আসে আবর্জনার স্তুপ। ফলে কক্সবাজার নিয়ে পর্যটকদের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।’
বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা
স্বাভাবিক সময়ে পর্যটনকে ঘিরে কক্সবাজারে বছরে কয়েক কোটি মানুষের আগমন ঘটে। এছাড়া পৌর এলাকায় রয়েছে ৫ লাখের বেশি স্থায়ী বাসিন্দা। পর্যটন মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন ১৪০—১৫০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। স্বাভাবিক সময়ে এর পরিমাণ ১২০—১৩০ টন হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পর্যটন এলাকা ছাড়াও শহরের প্রধান সড়কের বিজিবি ক্যাম্প এলাকা থেকে লালদীঘি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ডাস্টবিনে বিকাল পর্যন্ত আবর্জনা পড়ে থাকে। কুকুর—গরুর বিচরণে এসব আবর্জনা ছড়িয়ে যায় সড়কের ওপরেও। শহরের প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন উপসড়কে আবর্জনার স্তুপ দেখা গেছে। নির্ধারিত সময়ে আবর্জনা সংগ্রহ না করায় তা নালা—নর্দমায় পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
শহরের বর্জ্যগুলো প্রতিদিন সকাল ৮টার আগে পৌর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া কথা। তবে অভিযোগ আছে, তারা নির্ধারিত দায়িত্ব না পালনের কারণে ময়লা—আবর্জনায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে পর্যটন এলাকায়। পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৫০০ পরিচ্ছন্ন কর্মী। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার অস্থায়ী ডাস্টবিন থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করে ফেলা হচ্ছে বাঁকখালী নদীর তীরে। গত কয়েক বছর ধরে ফেলা আবর্জনায় ইতোমধ্যে নদীর তীরের প্রায় পাঁচ একর জমি ভরাট হয়ে টিলা আকৃতি হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলেই পানিতে ধুয়ে এই বর্জ্য বাঁকখালী নদী হয়ে সাগরে মিশে যায়। নদী ও সাগরের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ছে। তবে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ৫০০ পরিচ্ছন্ন কর্মী। তাঁরা দিনরাত কাজ করছে বর্জ্য অপসারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সন্তোষ কুমার দেব বলেন, ‘টেকসই পযর্টনের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পযর্টন নিশ্চিত করতে নান্দনিকতা প্রয়োজন। এজন্য শহরকে চমৎকার করে গোছাতে হবে। দেশি ও আন্তর্জাতিক পযর্টকদের আকর্ষণ করতে পর্যটন এলাকাকে সুন্দরভাবে সাজাতে হবে।’ কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবছর পর্যটনকে ঘিরে কয়েক কোটি মানুষের আগমন ঘটে কক্সবাজারে। কিন্তু গেল ৫০ বছরেও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি কক্সবাজারকে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সড়কের দুরবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। কিন্তু এরপরেও কোনো সুফল মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছর পর এই শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে।’ তবে বর্তমানে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও কক্সবাজার পৌরসভা নতুনভাবে পর্যটন শহরকে সাজাচ্ছে। কক্সবাজারকে পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা ছিল পৌর মেয়রের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রধান প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সাড়ে চার বছরেও সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের।
পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম তারিকুল আলমও গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজী হননি।
ড্রেনেজ সিস্টেম: কক্সবাজার পৌরসভা নতুনভাবে সড়ক—উপসড়ক করলেও পরিকল্পিতভাবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করেনি। যার দরূন ময়লা আবর্জনা ড্রেনে জমে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।
মাস্টারপ্ল্যান
পর্যটন শহর ও সেন্টমার্টিন ঘিরে মাস্টারপ্ল্যানে আলাদা নীতিমালা থাকবে বলে জানিয়েছেন পর্যটন সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, আগামী ডিসেম্বরে পর্যটনে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শেষ হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে পর্যটন শহরের পুরো চিত্র।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর নুরুল আবছার বলেন, ‘শহরের টার্মিনাল থেকে হলি ডে মোড় পর্যন্ত প্রশস্ত নালাসহ প্রধান সড়কটির উন্নয়ন কাজ শিগগিরই শেষ হবে। কিন্তু বর্তমানে প্রধান সড়কের কাজ বন্ধ রয়েছে। এতে নিমার্ণ কাজ কখন শেষ হবে তা আদৌ কেউ জানে না। যার ফলে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে জনদুর্ভোগ।