আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। জীবিত অবস্থায় শেষবারের মতো স্বদেশে এসেছিলেন ২০১৯ সালে। ২০১৯ সালের ৯ জুন গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা জানান।
আপনার এমন কোনো স্বপ্ন কি আছে যেটা পূরণ হয়নি? জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে আপনি এসে পড়েছেন…
: হ্যাঁ, পূরণ হয়নি। আমি ভাবছিলাম মৃত্যুকালে দেশটাকে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থাৎ সোশ্যালিস্ট, সেক্যুলারিস্ট হিসাবে দেখে যাব। আবার ব্রিটিশ আমলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল বাবা, চাচা, দাদা, কাকা যেমন ঈদের সময় তারা আমাদের বাড়িতে আসত, আবার সরস্বতী পূজা বা দুর্গাপূজার সময় আমরা তাদের বাড়িতে যেতাম, ওই অনুরূপ একটা আবহাওয়া, মিশ্র সংস্কৃতি ছিল আমাদের। হিন্দুরা প্রণাম করত, তারপর নমস্তে বলত, আমরা সালাম বলতাম, সালাম-আদাব বলতাম। এখন সে মিশ্র কালচারটা সম্পূর্ণভাবে ভাঙছে। হিন্দুরাও ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে ‘খোদা হাফেজ’ বলে, তাদের যে একটা আলাদা সংস্কৃতি ছিল, সেটাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন এখানে ওয়ান কালচার চালু হইছে, যেটার মধ্যে বাঙালিত্ব নাই।
আপনি বরিশালের মানুষ। বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন-‘আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়।’ আপনি দীর্ঘকাল প্রবাসে লগ্ন হয়ে আছেন। কিন্তু মন প্রাণ আপনার বাংলাদেশে পড়ে আছে। আপনার অন্তিম ইচ্ছাটা কী হবে দেশ নিয়ে?
: অন্তিম ইচ্ছাটা পূরণ করে রেখেছি। সেটা হচ্ছে, বাংলার মাটিতে আশ্রয় নেওয়া। সেই কবরটা আমি মিরপুরে তৈরি করে রেখেছি, সেখানে এবারে এসে দেখলাম, ফুল ফুটেছে।
বর্তমান বাংলাদেশে তো এখন কার্যকর বিরোধী দল আমরা দেখি না। এটা কি কোনো একটা সংকট? আপনার কী মনে হয়?
: স্বাধীনতার পর পার্লামেন্টে একটা কার্যকর বিরোধী দল যদি থাকত, তাহলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা খুব সহজ হতো না। যুদ্ধটা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির ভেতর না, যুদ্ধটা স্বাধীনতার শত্রু এবং স্বাধীনতার মিত্র পক্ষের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ যে কোনোভাবেই নির্বাচনে জয়ী হোক, আমি খুশি। কিন্তু পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগেরই উচিত গণতান্ত্রিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একটা বিরোধী দল গড়ে উঠতে সাহায্য করা। তা না করে যে একটা শূন্যাবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে আবার পঁচাত্তরের মতো ঘটনা ঘটানোর জন্য ষড়যন্ত্র হতে পারে।
এক সময় তরুণ বয়সে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন। আমরা কিন্তু সেই প্রত্যাশিত ভূমিকাটা দেখতে পাইনি কমিউনিস্টদের। কারণটা কী?
: কমিউনিস্টদের আন্দোলন কখনোই ভূমিনিষ্ঠ হতে পারেনি। তারা সব সময়ই সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য, আরেক দল চীনের সাহায্য নিয়ে এখানে নিজেরা শক্তিশালী হয়েছে। যেমন- জামায়াত সৌদি আরবের অর্থে ব্যাংক, বিমা, নানারকম অনুষ্ঠান করে অর্থকরীভাবে শক্তিশালী হয়, রাজনৈতিকভাবেও শক্তিধর থাকে। কমিউনিস্ট পার্টিরও তাই হয়েছিল, তাদের প্রকাশনা, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, তাদের হাসপাতাল, তাদের অমুক-তমুক। কিন্তু তারা জনগণের সঙ্গে মিশে যায়নি। যেই মাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য বন্ধ হয়েছে তারা ভেঙে পড়েছে। বিএনপির বরং মাটির সঙ্গে একটা যোগ আছে। কিন্তু সেই মাটিটা নির্ভরযোগ্য মাটি না। কারণ সেখানে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের তারা সহযোগিতা করে। বঙ্গবন্ধুর এবং স্বাধীনতার আদর্শগুলোকে। তাদের উচিত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কর্মসূচিভিত্তিক যুদ্ধ করা। কারা দেশ শাসনে ভালো কর্মসূচি দেয়, যদি তারা আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কর্মসূচি দেয়, তারা যাবে ক্ষমতায়। তা না করে তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে মুক্তিযুদ্ধের মূল ইস্যুগুলোর বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের চরিত্র হনন করেছে। আমার মনে হয় না এ দেশে মুসলিম লীগের মতো তাদের পতন হবে।
কিন্তু একটা বিরোধী দলের শূন্যতা তো সাধারণ মানুষের মধ্য আছে, প্রত্যাশা আছে একটা ভালো বিরোধী দল হয়ে উঠুক, সেক্ষেত্রে আপনার একটি লেখায় পড়েছি, এরকম পর্যবেক্ষণ-একটি দল যখন দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকে তখন সে অজনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন বাংলাদেশে এই বর্তমান সরকার ১০ বছরের বেশি সময় টানা ১২ বছর প্রায় ক্ষমতায়। জনমানুষের কাছাকাছি যাওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতায় থাকলে প্রতিবন্ধকতা থাকে। সেক্ষেত্রে অজনপ্রিয় হওয়ার কি আশঙ্কা থাকে? বা সাধারণ মানুষের পাল্স না বোঝার?
: শেখ হাসিনা খুবই জনপ্রিয়, তার সমতুল্য নেতা বাংলাদেশে নেই। কিন্তু তার দলটি ক্ষমতায় আছে বটে, কিন্তু জনপ্রিয়তা নেই। তার মূল কারণ, দলে এতসব অজনপ্রিয়, অতীতের বিতর্কিত নেতারা ঢুকেছেন, প্রাধান্য বিস্তার করেছেন এবং জিয়াউর রহমানের সৃষ্ট দল এসে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আরেকটি টার্মে যাওয়া, আমি আশা করি আওয়ামী লীগ আরও একটি টার্মে যাবে, যাওয়াটা খুব দুরূহ।
আপনি আপনার লেখায় অনেক সতর্ক করছেন। বারবারই কঠিনভাবেই করছেন। সেই বোধোদয় কি হচ্ছে?
: মনে হয় না, এখন প্রায় ১৫ বছর যে ক্ষমতায় থাকার একটা দম্ভ এটা অনেককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। চক্ষু দৃষ্টি থাকে না। এ জন্য বকাউল্লা বকলেও শুনাউল্লা শোনে না (হাসি)।
আচ্ছা, একটা প্রশ্ন-কেউ কেউ বলেন-এ দেশে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারা বিভিন্ন সময়ে সুবিধার কারণে এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ আওয়ামী লীগেও গেছেন আবার কেউ কেউ অভিযোগ করেন, যেমন-কাদের সিদ্দিকী অভিযোগ করেন কিছু যুদ্ধাপরাধী এবং কিছু স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ আওয়ামী লীগেও আছেন। আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষরা বলে যে আওয়ামী লীগে যখন কোনো রাজাকার যান, তখন তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যান। এটা আপনি কীভাবে দেখেন?
: (হেসে) একটা কথা প্রচলিত আছে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার হতে পারে। কিন্তু রাজাকাররা কখনো মুক্তিযোদ্ধা হয় না।