বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন প্রতিবছরই বাড়ছে। পাশাপাশি ছোট ছোট নতুন কিছু খাত নিয়মিত যুক্ত হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর কোনো কোনোটির পরিমাণ বাড়ছে। এসব খাতে কাজ করে কিছু মানুষের আয়-উপার্জনও হচ্ছে। অর্থনীতির আকার বেড়ে চলার বিষয়টি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে অনেকটাই প্রতিফলিত হয়। তবে গত প্রায় এক দশকে ছোট অথচ নতুন খাতের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো জাতীয় আয়ের হিসাবরক্ষণে যুক্ত হয়নি। শুধু নতুন নয়, অনেক আগে থেকেই সীমিত পরিসরে হলেও মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, এমন কিছু খাত বরাবরই এই হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে।
এ রকম একটা অবস্থায় সরকার নতুন কয়েকটি খাত যুক্ত করে নতুন ভিত্তি বছরের ওপর জাতীয় আয়ের হিসাব-নিকাশ করতে যাচ্ছে বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে (এফওয়াই ’১৬ টু বি নিউ জিডিপি বেজ ইয়ার—দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস; ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯)। আসলে নতুন ভিত্তি বছর ধরে জাতীয় আয়ের হিসাব-নিকাশ করার পরিকল্পনাটি গত প্রায় দুই বছর ধরেই আলোচনায় রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো জাতীয় আয়ের ভিত্তি বছর পরিবর্তন করা হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরকে ভিত্তি বছর ধরে জাতীয় আয়ের হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে টানা দুই দশক। ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে এসে এই ভিত্তি বছর পাল্টে করা হয় ১৯৮৪-৮৫। এরপর ১৯৯৯-২০০০ সময়কালে আবার ভিত্তি বছর হালনাগাদ করে নির্ধারণ করা হয় ১৯৯৫-৯৬। এরপর এক যুগ অতিক্রম করে এসে ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে নতুন ভিত্তি বছর করা হয়। প্রসঙ্গত, ভিত্তি বছর হলো একটি সুনির্দিষ্ট বছর বা অর্থবছর, যখনকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাজারমূল্যকে ভিত্তিমূলক স্থিরমূল্য বিবেচনা করা হয়। এর ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী বছরগুলোর জিডিপির বাজারমূল্যকে স্থিরমূল্যে রূপান্তর ও তুলনা করা হয়। প্রতিবছরের বাজারমূল্যকে স্থিরমূল্যে রূপান্তর করা না হলে সঠিক তুলনা করা সম্ভব নয়। কেননা মূল্যস্ফীতির কারণে প্রতিবছরই বিভিন্ন পণ্য ও সেবার বাজারমূল্য পরিবর্তিত হয়। সহজভাবে বললে, জিডিপি যেহেতু বিভিন্ন পণ্য এবং সেবার মোট পরিমাণ ও দামের গুণফল, তাই এক বছরের বাজারমূল্যের ওপর সে বছর যা জিডিপি হয়, তা আগের বা পরের বছরের সঙ্গে সঠিকভাবে তুলনীয় হতে পারে না। এ জন্য প্রতিবছরের বাজারমূল্যের জিডিপিকে ভিত্তি বছরের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়, যা সে বছরের স্থিরমূল্য হিসেবে বিবেচিত।
আবার ভিত্তি বছর পাল্টানো একটি স্বাভাবিক ও স্বীকৃত কাজ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত ১০ বছর পরপর এটি পাল্টানো হয় বা নতুন ভিত্তি বছর গ্রহণ করা হয়। কোনো কোনো দেশে পাঁচ বছর অন্তর এটি পরিবর্তিত হয়। তবে ভিত্তি বছর পাল্টানো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের বিষয়। এটি পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে তুলনার জন্য আগের ও পরের বেশ কয়েকটি অর্থবছরের জিডিপির হিসাবও সমন্বয় করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে জাতীয় আয়ের হিসাব-নিকাশ সংশোধিত হয়, হালনাগাদ হয়।
বিদ্যমান অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির কিছু অংশ জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে তার অর্থমূল্য নির্ধারণ ও অর্থনীতিতে অবদান রাখার হিস্যা নির্ণয়ের জন্যও জিডিপির হিসাব সংশোধন বা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। এখানেও বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। যেমন পরিবহন খাতে যে চাঁদাবাজি হয়, তা অবৈধ ও অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কাজ এবং প্রত্যক্ষ করের আওতার বাইরে থাকে। তবে এই চাঁদাবাজেরা যখন আবার চাঁদার অর্থ বাজারে ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে ব্যয় করে, তখন তার অনেকটাই পরোক্ষ করের (ভ্যাট) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক খাতে প্রবেশ করে। তাহলে কি চাঁদাবাজি বৈধ হয়ে গেল? বা আনুষ্ঠানিক খাতের কর্মকাণ্ড হয়ে গেল? সেটি হয় না বটে, তবে আনুষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে সংযোগ বেড়ে যায়। আবার নারীরা সন্তান লালন–পালনসহ পরিবারের যেসব কাজ করেন, তা থেকে তাঁরা কোনো পারিশ্রমিক পান না বলে সেগুলো উপার্জনমূলক কাজ বলে বিবেচিত হয় না। কিন্তু এসব কাজের অর্থমূল্য নির্ণয় করা হলে তা অর্থনীতিতে তথা জাতীয় আয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এক উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেব বিবেচিত হতে পারে।
প্রস্তাবিত নতুন ভিত্তি বছর থেকে প্রচলিত ১৫টি খাতের সঙ্গে আরও ছয়টি খাত যুক্ত হয়ে মোট ২১টি খাতের বাজারমূল্য যোগ করে জিডিপি নির্ণীত হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই জিডিপির আয়তন অনেক বেড়ে যাবে। বলা যায়, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির পরিধি বাড়বে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত ছোট পরিসরে হলেও যুক্ত হচ্ছে। যেমন ছয়-সাত বছর আগের ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য তেমন দৃশ্যমান হতো না। এখন তো শ খানেকের বেশি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় নিয়োজিত। দিন দিন তা বাড়ছে। তিন বছর আগেও রাইড-শেয়ারিং ছিল দ্বিধাগ্রস্ত পদক্ষেপ। কিন্তু এখন তা বহু মানুষের আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।
অথনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তারকারী নতুন খাতসহ বিভিন্ন খাত সম্পর্কে ভালোভাবে জানার জন্য প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক শুমারি। আর তা হালনাগাদ করতে প্রয়োজন নিয়মিত জরিপ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শুমারি-২০১৩ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালের শেষ দিকে। এরপর আর কোনো শুমারি হয়নি। ফলে আরেকটি অর্থনৈতিক শুমারি এখন বোধ হয় সময়ের দাবি। নতুন জিডিপির হিসাব–নিকাশ এই শুমারি ছাড়া কতটা অর্থবহ হবে, তা একটি প্রশ্ন।
বস্তুত, জিডিপির নতুন হিসাব প্রশ্নহীনভাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই। বরং প্রশ্ন থাকবে, নতুন খাতগুলো কোন বিবেচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে? কীভাবে দ্বৈত গণনার সমস্যা এড়ানো হয়েছে? জিডিপির আয়তন বাড়ার ফলে বিশ্ব অর্থনীতির তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানের পরিবর্তন কীভাবে মেলানো হবে? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পক্ষ থেকে এসব এবং এ রকম আরও সব প্রশ্নের তথ্যভিত্তিক ও ব্যাখ্যামূলক জবাব নিশ্চয় পাওয়া যাবে, এটা আশা করা যেতে পারে।