The news is by your side.

কবি শামসুর রাহমান: বুক তার বাংলাদেশের হুদয়

0 649

 

 

কবি শামসুর রাহমান। বাংলাদেশের কবিতায় উত্তরকালে শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিকতার বিভায় নতুন মেধা ও মননের সৃষ্টিতে জ্বলে উঠলো নতুন চেতনায়। আধুনিক জীবনবোধ, সমাজ, সময় ও রাজনৈতিক পটভূমি শামসুর রাহমানের কবিতায় দ্যুতিতে ছড়িয়ে পড়লো নতুন বিভায়। তাইতো শামসুর রাহমানই আমাদের পরিপূর্ণ অধুনিক কবি। নিজস্ব কাব্য ভাষা, স্বকীয় চিত্ররূপ, সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতি, বাস্তবতা, মানবিক সব সংকট ও নাগরিক জীবনবোধ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার চেতনা, তার কাব্য ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে নানাভাবে। ঐতিহ্য চেতনা ও সমাজের জাগতিক পটপরিবর্তনের ধারাবাহিক বৈপ্লবিক সময়কে তিনি তুলে এনছেন সুবিন্যস্ত করেছেন কবিতার নিজস্ব বৈচিত্র্যতায়।

দেশ চেতনা, মধ্যবিত্তের টানাপড়েন, সামষ্টির সংকট, গণআন্দোলন, স্বাধীনতার তীব্র আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা, সংগ্রামী প্রবণতায় শামসুর রাহমানের কাব্য জগৎ হয়ে উঠেছিল ঐশ্বর্যমণ্ডিত। তাইতো দেশ, কাল, সমাজ ও ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে শামসুর রাহমানের কবিতা সমুজ্জ্বল হয়েছে সর্বত্রই। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে যে ধারার চেতনা প্রবাহিত হয়েছিল তার মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমানের আবির্ভাব। ক্রমান্বয়ে নিজস্ব ক্রমবিকাশ, কবি শক্তির প্রদীপ্ত উচ্চারণ ও সৃষ্টিতে বাংলাদেশের কবিতায় আধুনিকতার বিভা জ্বলে উঠলো শামসুর রাহমানের কবিতায়। ১৯৫০ সালে কবি আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খাঁন সম্পাদিত ‘নতুন কবিতা’ সংকলনে শামসুর রাহমানের কবিতা ছাপা হলে একজন সম্ভাবনাময় ও কাব্য সৃষ্টির সৃজন ক্ষমতার অধিকারী কবি হিসেবে তীক্ষœবোধ ও মেধা-মননে তিনি হয়ে উঠলেন নতুন কালের অভিনব কণ্ঠস্বর এবং এর পূর্বে ১৯৪৮ সালে প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘উনিশশ ঊনপঞ্চাশ’ নলিনী গুহ সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’য় প্রকাশিত হয়েছিল।

পরবর্তীকালে শামসুর রাহমান পঞ্চাশ, ষাট, সওর, আশির দশকে রোমান্টিক প্রবণতার অধিকারী এক সৌন্দর্যবোধ নিয়ে রাজনৈতিক সচেতনতামূলক, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নানান বিষয় বৈচিত্র্যতায় কাব্যের শক্তিময়তায় প্রকাশ করেছেন নিজেকে অনায়াসেই। শামসুর রাহমানের চিন্তা-চেতনা ও মানস রূপের যেমন পরিবর্তন ঘটেছে তেমনিভাবে তার কবিতায় উপজীব্য হয়ে উঠেছে বিচিত্র বিষয় আঙ্গিক, উপমা ও রূপকল্প। তাইতো তিনি মানবিক জীবন, নাগরিক বোধ, স্বদেশ প্রেমের মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত জাতিসত্তার কবিরূপে স্বীকৃত হয়েছেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত প্রকাশিত শামসুর রাহমানের পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ যেমন- ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, এই সব কাব্যগ্রন্থে তার প্রতিভার সামাজিকবোধ, ছন্দের বৈচিত্র্যতা, কবির দৃষ্টিভঙ্গি ও কাব্য দর্শনে প্রকাশ পেয়েছে অনায়াসেই। সেই সময়ে লেখা ‘কখনো আমার মাকে’ বাংলা কবিতার প্রতি পাঠক সমাজের নতুন আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। ঊনসওরের গণআন্দোলন নিয়ে তার কবিতায় ধরা পড়েছে স্বদেশ প্রেমের নির্মোহ চিত্ররূপ। এটি তার লেখনিতে অব্যাহত থাকে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, হরতাল, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, আসাদের শার্ট, ইত্যাদি কবিতায়। অন্যদিকে, উন্মাতাল করা স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা আরো শাণিত হয়ে আলোড়ন তুলে মানুষের মনে যেমন- তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, তুমি বলেছিলে, কবিতায়। রাজনৈতিক সচেতন কবি শামসুর রাহমান সাংস্কৃতিক আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে নিজস্ব আত্মশক্তি, তা থেকে উৎসারিত হয়ে উচ্চারণ করেছেন চিত্রকলা সমৃদ্ধ অসাধারণ কবিতাবলি।

অন্যদিকে কবিতা বইয়ের মধ্যে ‘নিজ বাসভূমে (১৯৭০) ও বন্দি শিবির থেকে (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থে উঠে আসে কবিতাগুলো মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের প্রত্যক্ষ সময়ের ফসল। নিজস্ব চেতনায় অনুভূতির ও সময়ের তীব্র উত্তাপের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন আলোচ্য কবিতাগুলো। স্বদেশের পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বাস্তবতা, জাতির ইতিহাস, যুদ্ধোত্তরকালে স্বদেশের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশাকে ধারণ করে কবিতার প্রেক্ষাপটে তিনি চেতনায় ধারণ করেছেন। গণআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের চিত্রাবলি ও সংগ্রামের সিঁড়িপথ রচিত হয়েছে কবিতায়। যেমন-

‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্য

আর কতকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়

আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?…

পৃথিবীর ক‚লে নতুন নিশানা উড়িয়ে

দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক এই বাংলায়

তোমাকে আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।

-তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা-বন্দি শিবির থেকে

একদিকে স্বদেশের ধ্বংসলীলা অন্যদিকে হত্যা, মৃত্যু ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বদেশ গড়ার স্বপ্ন জাগানিয়া প্রতীকী ব্যঞ্জনায় রূপ পেয়েছে ভিন্ন উপমা ও চিত্রকল্পে। শামসুর রাহমান সম্বদ্ধে এক প্রবন্ধে ভাষা গবেষক, প্রয়াত কবি অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন- ‘আধুনিক কবি শামসুর রাহমানের আত্মপ্রকাশে তিরিশের উওরসূরি আধুনিক কবি ও কবিতাকে অক্ষুণœ রেখেছেন। শামসুর রাহমান তো পঞ্চাশের কাব্য প্রতিভা তাই তার স্বাতন্ত্র্য অবশ্যম্ভাবী। তিরিশের কবিতার কাব্য প্রতিভার মধ্যে শামসুর রাহমান তার সঙ্গে গেঁথেছেন বাস্তবতা ও অব্যবহিত প্রতিবেশ ও সময়। শামসুর রাহমান সমকালে বিস্তৃত ও বাস্তবতাকে ধারণ করেছেন। তার কবিতায় উঠে এসেছে জাতীয় চেতনার প্রতিটি দ্রোহ, উন্মাতাল, আবহ, উওাপ, গণমুক্তির মুখর শব্দমালা। শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বাস্তব প্রতিবেশকে ব্যাপক বিস্তৃত বাস্ততবতাকে তার কবিতায় ধারণ করেছেন নমিত স্বভাবে। তাইতো তিনি বাংলাদেশের একমাত্র প্রধান কবি রূপে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। পঞ্চাশের দশক থেকে নতুন শতাব্দীর শূন্য দশক পর্যন্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শামসুর রাহমানের কবিতা যে চেতনা ও আকর্ষণের জোরে দীপ্যমান তা হলো তার কাব্যশৈলী, উপমা, প্রতীক, শিল্পরূপ ভাষার সারল্য, আধুনিক কবিতার শব্দ ও চিত্রকল্প কাব্য ভাষার গৌরবময় ঐতিহ্যে ও গভীর ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি তার কবিতাকে যুগে যুগে মানুষের সুখও দুঃখের সাথী করেছে।

শামসুর রাহমানের কবিতা সবার চেতনা ও নাগরিক জীবনযাপনের চিত্রাবলিতে শাণিত বলেই চিত্রিত কাব্যের অধিকাংশ জুড়ে নগর জীবনের কথা উঠে এসেছে। নাগরিক অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সতেজ গ্রামীণ চিত্রকল্পের ব্যবহার মৃওিকার ঘ্রাণের মতো শব্দ প্রয়োগের সম্ভাব্যতা তিনি আয়ত্ত করেছেন অনায়াসেই কবিতায়। তিনি কবিতার শরীর জুড়ে কৈশোর যাপিত জীবন, জীবনের সামাজিক লোকালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস ঐতিহ্যে শাসিত শব্দমালা চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন সচেতনভাবেই। শামসুর রাহমানের হাতে সৃষ্টি হয়েছে শহরকেন্দ্রিক আজীবনের অনন্য কৈশোরের স্মৃতিচারণমূলক রচনা ‘স্মৃতির শহর’। নাগরিক জীবনযাপনের শহর ঢাকাকে নিয়ে কবি বলে উঠেন-

‘শামসুর রাহমান বলে আছে একজন,

যার প্রতি ইদানীং

বিমুখ নারীর ওষ্ঠ, শিল্পকলা বাগানের ফুল।

সবাই দরজা বন্ধ করে দেয় একে এক মুখের ওপর,

শুধু মধ্যরাতে ঢাকা তার রহস্যের অন্তর্বাস খুলে বলে-

ফিরে এসো তুমি।

মধ্যরাতে ঢাকা বড় বড় একা বড় ফাঁকা হয়ে যায়,

অতিকায় টেলিফোন নেমে আসে গহন রাস্তায় জনহীন

দীর্ঘ ফুটপাত

ছেয়ে যায় উঁচু উঁচু ঘাসে সাইনবোর্ডের বর্ণমালা

কী সুন্দর পাখি হয়ে রেস্তোরাঁর আশপাশ ছড়ায় সংকেত

একজন পরী হ্যালো হ্যালো বলে ডায়াল করছে অবিরাম

মধ্যরাতে ঢাকা বড় একা বড় ফাঁকা হয়ে যায়।

-পারিপার্শ্বিকের আড়ালে- শূন্যতায় তুমি শোকসভা

স্বাধীনতা-উওরকালে শামসুর রাহমান কাব্য সাধনায় হয়েছেন নিবিড়, স্পন্দিত, চেতনাপ্রবণ সমাজের উত্থান-পতন, রাজনীতিতে পরিবর্তনের ঢেউ, অপশক্তির তৎপরতা, নাগরিক জীবনের স্বপ্নভঙ্গ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানবিক জাগরণ ও তার নির্যাতনের চিত্রাবলি, তার কবিতায় উঠে এসেছে নিবিড় লেখনির শক্তিতে। রাজনীতি যখন তার উপলব্ধিতে প্রত্যয়ী হয়ে উঠে তখন সেই ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক কবিতার জন্মলাভ করে। এ দেশের রাজনীতির পরিবর্তন সাংস্কৃতিক চেতনায় নতুনতর প্রবাহের সৃষ্টি করেছে। যার প্রতিফলন আমরা খুঁজে পাই স্বাধীনতা-উওর বাংলাদেশের কবিতায়। তেমনিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ও পরে স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থির সময়ের চিত্র শামসুর রাহমানের কবিতায় ছায়া ফেলেছে নানান মাত্রায়। তাইতো কবি বলে উঠেন-

‘সারারাত নূর হোসেনের চোখে এক ফোঁটা ঘুমও

শিশিরের মতো

জমেনি, বরং তার শিরায় শিরায়

জ্বলেছে আতশবাতি সারারাত, কী এক ভীষণ

বিস্ফোরণ সারারাত জাগিয়ে রেখেছে

ওকে, ওর বুকে ঘন ঘন হরিণের লাফ,

কখনো অত্যন্ত ক্ষিপ্র জাগুয়ার তাকে প্রতিদ্ব›দ্বী ভেবে জ্বলজ্বলে

চোখে খর তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে,

এতটুকু ঘুমোতে দেয়নি।

উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে

রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য শ্লোগান,

বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছেলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ

শহরের টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সিসা

নুর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হুদয়

ফুটো করে দেয়; বাংলাদেশ

বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার

বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।

– বুক তার বাংলাদেশের হুদয়

স্বৈরাচারী শাসনের অত্যাচারের নির্মমতায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ, রাজপথ যখন সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হতো প্রতিদিন, সূর্য সৈনিকদের মতো নূর হোসেনের মৃত্যুহীন প্রাণ একটা নতুন মুক্তির পথ এঁকে দিয়েছিল সমগ্র জাতির সংগ্রামী চেতনায়। শোষণ থেকে মুক্তির অলোকিত পথ তৈরি করেছিল নতুন পথে স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজ নির্মাণের দিকনির্দেশনায় এগিয়ে গেল। স্বদেশের চেতনা ধারার মানুষ কবি শামসুর রাহমানকে মাতৃভূমির সমাজ চেতনা প্রবাহিত করেছিল, করেছিল আলোড়িত। তাইতো মানবতাবাদী কবি উচ্চারণ করেছিলেন এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শব্দমালা। নিজস্ব মাতৃভূমির প্রতি প্রেম শামসুর রাহমানকে নিয়ে যায় সমাজ বাস্তবতার দিকে।

স্বাধীনতা-উওর বাংলাদেশের নিবিড় সামাজিক পটপরিবর্তনের ঘটমান ঘটনাবলি পতাকার মতো পবিত্রতায় সমুজ্জ্বল হয়েছে কবির কবিতায়। প্রতিক্রিয়াশীল কবিতায় শামসুর রাহমানের কবিতা হয়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রের মতো গুরুত্ববহ। ফলে তার কবিতা হয়ে উঠেছে সমাজবাস্তবতা নাগরিক জীবনবোধ ও স্বদেশ চেতনায় বহুমুখী জীবনধারার চিত্ররূপ। তিনি একে একে হয়ে উঠলেন জীবন ভাবনার কবি, স্বাধীনতার কবি। তার কবিতা হয়ে উঠলো পতাকার মতো স্বাধীনতার প্রতীক।

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.